Press "Enter" to skip to content

মাঠ ভরা পাকা ধান। অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে মায়ের মুখের মধুর হাসিই যেন ছড়ানো! মাঝে মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছে কাকতাড়ুয়া…..।

Spread the love

অ ঘ্রা নে র ঘ্রা ণ

আত্মকথায় বাবলু ভট্টাচার্য : ঢাকা, রোদের রঙ যখন হলুদ হয়ে আসে, ছায়াগুলো দীর্ঘ হয়। আর দিনের প্রথমভাগ ফুরিয়ে যায় খুব দ্রুত। বিকেল যেন ঝপ করে নেমে আসে আকাশ থেকে। বাতাসে শীতের ঘ্রাণ। এই রকম কোন অঘ্রানের বিকালে, আমার কেবলই শৈশবের কথা মনে পড়ে। আমি চোখ বুজে জোরে শ্বাস নিই… ঠিক যেন আমার ছেলেবেলার অঘ্রানের গন্ধ। আমার মনে হয়, আমার শৈশবেও এমনি করেই হেমন্ত আসতো, আর হেমন্তের হাত ধরে আসতো শীত।

সুপুরিগাছগুলোর লম্বা ছায়া পড়ে মাঠের মধ্যে। বাড়ীর সামনের কাঁঠালগাছ থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে হলুদ পাতা। একটু দুরে শস্যহীন মাঠে হলুদ হয়ে থাকে সোনালি রোদ্দুর। একছুটে চলে যেতাম ধানকাটা মাঠে।

চোরাকাটা ভরা মাঠে রঙিনপাখা মেলে দিয়েছে ফড়িঙের দল। একটু দুরে একটা গরু অলসভাবে জাবর কাটছে। তার পিঠের ওপর নির্ভয়ে বসে একটা ফিঙে ত্রিং ব্রিং করছে।

একদম গ্রামে, বিকেলবেলা কুয়াশা আর ধোঁয়া গাছপালা ঢাকা বাড়িগুলোর উপরে স্তব্ধ হয়ে থাকে। বরই গাছের নিচে ছেলেমেয়েদের জটলা। ঢিল ছুড়ে ওই কাঁচা বরইয়ের ঝাঁক থেকে একটা কি দুটো ঈষৎ পাকা কুল কে পাড়তে পারে, তারই প্রতিযোগিতা।

মাঠ ভরা পাকা ধান। অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে মায়ের মুখের মধুর হাসিই যেন ছড়ানো! মাঝে মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছে কাকতাড়ুয়া।

ধানকাটা শুরু হলো তো শুরু হয়ে গেল উৎসবের দিন। ধান কাটা কিষাণদের খাওয়ানো হতো পেটপুরে। আমরা, ছোটরাও বসে যেতাম সেই কিষাণদের সারিতে (পঙক্তিতে)। সার ধরে কলা পাতা পড়ত। তারপর জল ছিটিয়ে পাতা পরিস্কার। পাতার এক কোনায় একটু লবণ। তারপর আসতো ধোঁয়া ওঠা গরম গরম লাল চালের ভাত। সে যে কি স্বাদ! কি মজা!

কাটা ধান বাকে নিয়ে, মাথায় নিয়ে কিষাণরা বাড়ি ফেরে। সোনালি খড়ের শোভায় কোন বরিশালে জীবনানন্দ দাশ ব্যাকুল হয়ে উঠছেন… ধান কাটা হয়ে গেলে যে শূণ্য ক্ষেত, তার নিঃসঙ্গতাতেও তিনি ব্যথা পাচ্ছেন। আমরা তখন অত কিছু বুঝতে শিখিনি!

বাড়ির উঠোনে চলে ধান মাড়াইয়ের কাজ। গরুগুলো চক্রাকারে ঘুরতে থাকে বিছিয়ে দেয়া ধানের উপর দিয়ে। ধান সেদ্ধর কাজ চলে সারারাত। সারাদিন সেই ধান উঠান জুড়ে শুকানো হয়।

বিশাল কঞ্চি নিয়ে একপাশে বসে থাকি, পাখি তাড়াতে হবে। তারপর শুরু হয়ে যায় ঢেঁকির ধানভানা মধুর আওয়াজ। কেমন করে চুড়িপরা হাতগুলো ঢেঁকির ধনেশ পাখির মতো ঠোঁটটা নেমে আসার আগেই ধানগুলো, কুড়োগুলো নেড়ে দিয়ে সরে পড়ে। কি ছন্দ, কি নিয়ম, কি সৌন্দর্য! নরম চাল থেকে চালের গুড়ো ভানা হচ্ছে ওই ঢেঁকিতেই… পিঠা হবে। শুরু হয়ে যায় পিঠা বানানোর উৎসব। পাটিসাপটা, ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা… আমি বলতাম শিঙাড়া পিঠা।

ধানের মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে আসতেন ফেরিওয়ালা। শিকে বাকের একপাশে থাকতো, বিস্কুট, সাবান। কাচের চুড়ি। লাল রঙের চুলবাঁধা ফিতা… আরও কত কি! ধামা ভরে ধানের বিনিময়ে সেসব সংগ্রহ করতেন বাড়ীর বউ-ঝিরা।

আর একটু এগিয়ে গেলেই রোগা নদী। এতো শীর্ণ, মনে হয় যেন পায়ে চলা আঁকাবাঁকা পথ। কুয়াশা থমকে আছে তার উপরে। জলও যেন নড়ছে না। নদীর জলে পাতাশূণ্য ডাল পালার ওপরে ধ্যানমগ্ন স্থির বসে আছে একটা মাছরাঙা।

সেই মরা নদী, হয়তো যার ছিল ভরা অতীত, তার পাড় ধরে রোপা হচ্ছে ফুল কপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলো কিংবা পালংশাক। কলাগাছের বাকল দিয়ে প্রতিটি চারাকে ছাউনি দেয়া হয় কড়ারোদ থেকে বাঁচাতে। বিকেলবেলা নদী থেকে জল তুলে এনে ঝাঁজরি দিয়ে প্রত্যেকটা গাছের গোঁড়ায় দেয়া হয়। সকালবেলায় সেই গাছের পাতায় শিশির টলমল করে। তার ওপরে পড়ে সকালবেলার চনমনে রোদ।

মায়ের হাতে উলের বল, দুটো কাঁটা কি কৌশলে বুনে যায় লাল সোয়েটার কিংবা মাফলার। সুযোগ পেলেই হাত থেকে ফসকে সেই উলের বল লাফাতে লাফাতে চলে যায় অগম্য কোনো কোনায়।

সব কিছু বদলে যায়। কিছুই আর ফিরে আসে না। বৈশ্বিক উষ্ণতায় এই অঘ্রাণের রাতেও মাথার ওপরে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। তবুও পথ চলতে গিয়ে ফুটপথে পড়ে থাকা শীর্ণ শিউলিগুলো দেখে থমকে যাই। হাতে তুলে ঘ্রাণ নিতেই অঘ্রানের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। শৈশবের স্মৃতি মাথার মধ্যে ভীড় করে। আউলা-ঝাউলা হয়ে যায় মন।

সকালের মিষ্টি রোদে হাঁটতে ভালো লাগে। বিকেলের রোদের রঙকে ঠিক আমার শৈশবের মতো হলুদ দেখে ভাবি, নাকি কিছুই বদলায়নি, শুধু চুলগুলো ধুসর হয়ে যাওয়া ছাড়া।

আমাদের বার বার ফিরে যেতে হয় কবি জীবনানন্দ দাশের কাছে-
‘আমি এই অঘ্রানেরে ভালোবাসি
বিকেলের এই রঙ-রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বাদামি
পাখি-হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে
কুড়নির মুখে তাই নাই কোন কথা।’

More from GeneralMore posts in General »
More from SocialMore posts in Social »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.