স্মরণঃ ছা য়া দে বী
বাবলু ভট্টাচার্য : তিনি যখন অভিনয়ে আসেন তখন বাংলা সিনেমা সবে কথা বলতে শিখেছে। সবাক চলচ্চিত্রের সেই প্রথম যুগে যখন ভদ্রঘরের মেয়েদের সিনেমায় অভিনয় নিয়ে নানান বাঁকা মন্তব্য, তখন সেই সময়ের এক উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছায়া দেবী অভিনয়ে এলেন খানিকটা বাড়ির লোকেদের উৎসাহেই।
এই অভিনেত্রী পর্দায় কখনও কোনো ছেলের দজ্জাল মা, আবার কখনও ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউনের হতভাগ্য গর্ভধারিনী, যাকে নিজের মেয়ের সামনে আজীবন ধাইমা’র পরিচয় দিতে বাধ্য করেছিল পরিস্থিতি।
১৯১৪ সালের ৩ জুন ভাগলপুরে জন্মেছিলেন ছায়া দেবী।
তার পিতৃদত্ত নাম ছিল ‘কনক’। ছোটোবেলা থেকেই স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তায় বেড়ে ওঠা এই মেয়ের চোখে ছিল ডানা মেলার স্বপ্ন। কিন্তু মাত্র এগারো বছর বয়সে স্বামীর ঘর করতে এসে কনক কে শুনতে হয় মানুষটির এ সংসারে মন নেই। বিয়ে জিনিসটি ঠিক কী, তা বুঝে ওঠার আগেই নতুন বর তার বউকে ফেলে চলে গেল ওড়িশায় অধ্যাপনা করতে। কনক বুঝলেন তার একা থাকার সেই হল শুরু।
সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকা কনককে তার বাবা হারাধন তখন নিয়ে এলেন কলকাতায়।
পাশেই থাকতেন সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে। সম্পর্কে যিনি মান্না দে’র কাকা। সব মন খারাপ যেন চলে যেত কৃষ্ণচন্দ্রের সুরে। তাই ভাগলপুরে থাকতেই দামোদর মিশ্রের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের হাতেখড়ি হওয়া কনক ফের গান শিখতে শুরু করলেন তার ‘বাবুকাকা’ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। সঙ্গে পেলেন কিশোর মান্না দে’র সাঙ্গীতিক সাহচর্য। পাশাপাশি চলল শ্রদ্ধেয় শম্ভু মহারাজের কাছে উচ্চাঙ্গ নৃত্যের তালিম।
নাচ, গানের চর্চায় ডুবে ধীরে ধীরে মনের বিষাদ কাটিয়ে উঠলেন কনক। কিশোরী কনককে আরও একটু চনমনে রাখার কথা ভাবলেন তার পরিবার। ভাগলপুরের রাজবাড়ির নাতি কুমুদলাল, পরবর্তীতে যিনি অশোককুমার, তখন মুম্বাইয়ের তরুণ তুর্কি।
রাজপরিবারের বন্ধু উপেন গোস্বামী ফিল্ম কোম্পানির ম্যানেজার। এই যোগাযোগেই কিশোরী কনক এল লাইট, ক্যামেরার এক নতুন জগতে। জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পথের শেষে’ দিয়েই অভিনয় জগতে পথচলা শুরু হল কনকের, প্রথম ছবিতেই তাঁর নাম বদলে রাখা হয় ‘ছায়া দেবী’।
১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমায় ছায়ার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বিখ্যাত পরিচালক দেবকীকুমার বসু তাঁর ‘সোনার সংসার’-এর নায়িকা হিসেবে চাইলেন ছায়া দেবীকে। শুরু হল দক্ষ হাতে সোনা গলানোর কাজ।
দেবকীকুমারের কঠিন অনুশাসন ও অভিভাবকত্বে ছায়া দেবীর অভিনয়ে এল ধার ও চমক। ছবিটি মুক্তি পেতেই অজস্র প্রশংসা এল তাঁর ঝুলিতে। এরপর দেবকীবাবু বাংলা ও হিন্দিতে আনলেন ‘বিদ্যাপতি’কে। রানি লক্ষ্মীর চরিত্রে সিনেমাপ্রেমীদের যেন বশ করলেন ছায়া দেবী, তখন তিনি বয়সেও খানিক পরিণত।
অভিনয়ে তাঁর পারিশ্রমিক যখন বেশ সম্মানজনক, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন ‘নিউ থিয়েটার্স’ ছেড়ে দেবেন। দিলেনও। সিনেমার ছায়াকে এরপর নিয়মিত শোনা গেল রেডিওয়। জনপ্রিয় হল ছায়াদেবীর গাওয়া ঠুমরি, দাদরা।
এরপর সুশীল মজুমদারের জোরাজুরিতে সিনে জগতে ফিরলেন ছায়া দেবী। ‘অভয়ের বিয়ে’তে তিনি তখন পরিণত নায়িকা।
ভালোকে ভালো বলার অসামান্য গুণ ছিল ছায়াদেবীর। তাই তাঁর চেয়ে জুনিয়রদের ভালো কাজে সবসময় দেদার প্রশংসা করেছেন তিনি। চরিত্রের গভীরে ডুবে যাওয়া উত্তমকুমারকে শুধু তাঁর অসামান্য অভিনয় গুণের জন্যই স্নেহ করতেন না ছায়া দেবী, ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’র মা-ছেলের সম্পর্ক বাস্তবেও তেমন সত্যিই ছিল।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পর্দার মা ছায়া দেবীর সঙ্গে রিয়েল লাইফেও মিসেস সেনের সম্পর্ক ছিল বড়োই আপন। আত্মপ্রচার, ভিড়ভাট্টায় তীব্র অনীহায় অন্তরালবাসিনী ছায়া দেবীর সঙ্গে সাধারণ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া মহানায়িকার শেষদিন পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল ফোনে।
ছায়া দেবী-ছবি বিশ্বাস নিয়ে যেন তখন বাংলা ছায়াছবি। অভিজাত চরিত্রে ছবি বিশ্বাস থাকা মানেই দর্শক নিশ্চিত যে সে ছবিতে ছবি বিশ্বাসের ঘরনি ছায়া দেবী। চোখে জল আনার জন্য কখনও গ্লিসারিন লাগত না ছায়া দেবী, কানন দেবীর মতো সে যুগের অভিনেত্রীদের। আর এভাবেই অবলীলায় জীবন্ত হয়ে উঠেছেন ‘পদিপিসি’, ‘সাত পাকে বাঁধা’র মিসেস বসু, ‘আপনজন’-এর আনন্দময়ী চরিত্রে।
সংসার জীবনের শুরুতেই কাঁচা মন ভাঙার যন্ত্রণা বুকে ধারণ করতে হয়েছিল যে মানুষটিকে, শুধু অভিনয়ে নয়, তাঁর সমগ্র জীবনেই যে অনুভবের তীব্র ছোঁয়াচ থাকবে, এতে আর আশ্চর্য কী ! ‘দেয়া নেয়া’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘হারমোনিয়াম’-এর ছায়া দেবী তাই কখনও দর্শককে বুঝতে দেন না যে তিনি অভিনয় করছেন। সবসময় এতটাই সাবলীল আর প্রাণবন্ত তাঁর সংলাপোচ্চারণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।
ছায়া দেবী ২০০১ সালের আজকের দিনে (২৫ এপ্রিল) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment