ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১০ জুন ২০২৪।কাঁদতে কাঁদতে আমরা পৃথিবীর আলোয় আসি তখন অন্যরা হাসে ৷ আবার যখন সংসার ছেড়ে চিরবিদায় নি তখন আত্মীয় -পরিজন কাঁদে আর নিজে হাসিমুখে চলে যায় !
“কান্না ” হলো চোখের জল ৷জল , লবণ , কিছু এন্টিবডি ও এন্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টের মিশ্রণ ৷চোখের উপরের পাতার অশ্রু গ্রন্থি বা Lacrimal বা Tear Gland থেকে এর উৎপত্তি ৷চোখের উপরের অংশের কর্ণিয়া ও সাদা তন্তুতে অনেকগুলি ক্ষুদ্রাকৃতির অশ্রুনালী বা Tear duct থাকে ৷ এখান দিয়ে অশ্রু পুরো চোখময় ছড়ায় ৷ চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি থেকে প্রোটিনসমৃদ্ধ , ব্যাকটেরিয়ানাশক একরকম তরল বের হয় ৷ চোখ পিটপিট করলে ঐ তরল পুরো চোখে ছড়িয়ে যায় ৷ এভাবে ,চোখ ভিজে ও সুরক্ষিত থাকে ৷ একে বলে Basal tears বা মৌলিক কান্না ৷ যা অক্ষিগোলককে পিচ্ছিল করে , চোখকে পুষ্টি জোগায় ও ভিজে রেখে রক্ষা করে ৷পেঁয়াজের মত ঝাঁঝাল জিনিস কাটলে , লঙ্কার ঝাঁঝে বা রান্নার ঝাঁঝে চোখ দিয়ে যে জল বের হয় তাকে বলে Reflex tears বা প্রতিরোধী কান্না ৷ যা ক্ষতিকর ধোঁয়া , দূষিত বাতাস , রাসায়নিক পদার্থ থেকে চোখকে রক্ষা করে ৷ এর ফলে ময়লা , নোংরা , পোকামাকড় ঢুকলে বের হয়ে যায় ৷ কিছু অশ্রুনালী নাকেও থাকায় আবেগে চোখের সঙ্গে নাক দিয়ে জল ঝরে ৷ সজোরে হাসলেও চোখে জল এসে যায় ৷তবে , আমাদের বিষয় Physic tears বা প্রাকৃতিক কান্না বা ইমোশনাল কান্না৷ দুঃখ , হতাশা , বিষন্নতা ও মানসিক চাপ থেকে যে চোখের জল বা কান্না বের হয় ৷ এর লিউসিন , এনকেফ্যালিন প্রাকৃতিক বেদনা নাশক ৷ রিফ্লেক্স টিয়ার অন্য অনেক প্রাণীর হলেও ইমোশনাল টিয়ার সাধারণভাবে শুধু মানুষেরই হয় ৷অন্ধ লোমশ ইঁদুর আক্রামণাত্মক ইঁদুরদের থেকে বাঁচতে নিজের অশ্রু গায়ে মাখে ৷চার্লস ডারউইন লিখেছেন হাতিরা নাকি স্বজনের বিয়োগ ব্যথায় কাঁদে ! মস্তিষ্কের আবেগপ্রবণ অঞ্চল হাইপোথ্যালামাস ও ব্যাসাল গ্যাংগিলার সাথে ব্রেইন্সটেম এর ল্যাক্রিম্যাল নিউক্লিয়াস যুক্ত থাকে ৷তাতে অশ্রু তৈরী হয় ৷ মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস , আলঝাইমার , স্ট্রোকের রোগীদের অনেকের অবশ্য আভ্যন্তরীণ উদ্দীপনা ছাড়াও অশ্রুপাত হতে পারে ৷অশ্রুনালী বন্ধ হলেও চোখে জলধারা বয়ে যেতে পারে ৷ আবার শোগ্রেন্স সিনড্রোমে আক্রান্ত হলে কাঁদা সম্ভব হয় না ৷” আবেগ ” চেপে থাকতে নেই ৷ কিন্তু , শৈশব থেকে ছেলেদের শেখানো হয় কান্না একান্তভাবে মেয়েলি বিষয় ৷ বলা হয় মেয়েরা নাকি দূর্বল তাই তাদের কান্না সাজলেও পুরুষদের এমনটা শোভা পায় না ৷
তাই , মনের দুঃখ মনেই চেপে রাখায় নিজের মন হালকা হয় না ৷ এরফলে মানসিক রোগ এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও বেড়ে যায় ৷কাঁদলে ATCH বেশী বের হয় আবার কর্টিসোলের পরিমাণ কমে যায় তাই চাপ কমে ৷ আবেগজনিত অশ্রুর সঙ্গে লিউসিন এনকেফালিন নিঃসৃত হওয়ায় মানসিক চাপ ও শরীরের ব্যথা কমে ৷ ব্যথা নিরোধক ওষুধগুলির মত ৷অথচ , শরীর ও মনের চাপ ও উত্তেজনা দূর করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কান্না ৷কান্না চাপলে স্নায়ুর স্বাভাবিক কাজ বাধাগ্রস্ত হয় ৷ দুঃখ ও মানসিক চাপে এড্রিনাল গ্রন্থিগুলি এড্রেনালিন ও কর্টিসল সহ স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণের সংকেত দেয় ৷স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা শরীরের গভীরে ক্ষতিসাধন করে ৷এতে রক্তচাপ , হদস্পন্দন, কোলেস্টেরল , সুগার ইত্যাদি বৃদ্ধি পায় ৷ তাই মনের সঙ্গে লড়াই না করে কেঁদে মন হালকা করা উচিত ৷ জার্মান চক্ষুবিশেষজ্ঞ ভিঙ্গারহোটস সমীক্ষায় দেখেছেন বছরে নারীরা গড়ে ৩০ থেকে ৬৪ বার কাঁদলেও পুরুষরা ৬ থেকে ১৭ বারের বেশী কাঁদেন ৷ ব্রিটেনের গবেষণা
প্রতিষ্ঠান ইউগভ দেখেছে অধিকাংশ যুবক কান্নাকে পুরুষালী আচরণ নয় বলে মনে করে ৷অবশ্য একজন চিকিৎসক হিসাবে ফিজিওলোজি পড়ে জানি পুরুষদের শরীরের টেস্টোস্টেরণ হরমোন কান্নাকে দমনে ভূমিকা নেয় ৷ ঠিক উল্টোটা ঘটে নারীদের বেলায় ৷ তাদের দেহের প্রোল্যাক্টিন হরমোন কাঁদুনে প্রবণতা তৈরীর জন্য দায়ী ৷ সেরেটোনিন হরমোন ও কিছু নিউরোট্রান্সমিটার কান্নায় ভূমিকা রাখে ৷ বাচ্চা জন্মদানের পর ও প্রেমে পড়লে শরীরে ট্রিপটোফ্যান কমে ৷ তাই সদ্যপ্রসবা ও প্রেমিক -প্রেমিকা সহজে কাঁদে ৷বয়সন্ধিকালে টেস্টোস্টেরনের জন্য ছেলেরা কম কাঁদলেও প্রোজেস্টেরণ ক্ষরণের জন্য মেয়েরা বেশী কাঁদে ৷মহিলাদের অশ্রুনালী ছেলেদের চেয়ে কম দীর্ঘ বলে সহজে চোখে জল আসে ৷ আবার একজন শিশু মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কাঁদে ৷যদিও মানসিক চাপ , অবসাদ , ক্ষোভ , রাগ কাটাতে শুধু কান্না নয় জোরে চেঁচামেচি , গালিগালাজও উপকার দেয় ৷যারা ইতিবাচক খবরেও আনন্দ পায় না বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায় তারা দ্রুত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ৷তবে বেশী কাঁদলে ল্যাক্রিমালে জলশূন্যতা দেখা দিলে মাথাব্যথা হতে পারে ৷
একজন স্বাভাবিক মানুষের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিতে গড়ে রোজ ১০ আউন্স পর্যন্ত অশ্রু উৎপন্ন হতে পারে ৷শুধু লিঙ্গভেদে নয় দেশ ও সংস্কৃতির পার্থক্যেও কান্না কম -বেশী হয় ৷ আমরা দেখি চীন ও ঘানার বাচ্চারা খুব কম কাঁদে ৷ যদিও বাচ্চাদের দিনে তিন ঘন্টা কান্না স্বাভাবিক ৷ ইরানের মানুষ খুব বেশী কাঁদে ৷ ইসলাম ধর্মে কান্নার সমর্থনে অনেক কথা আছে ৷বৌদ্ধ ধর্ম জন্মান্তরে বিশ্বাসী বলে কারো মৃত্যুর পর কম কান্নাকাটি হয় ৷ ফিজিতে মৃতদেহ কবরস্থ করার আগে কান্না অনুমোদিত নয় ৷ সংবেদনশীল অশ্রু সামাজিক ও জৈবিক সংকেত তথা যোগাযোগের মাধ্যম ৷ মন ও শরীরের এমন নানা বিষয়ে আরো সবিস্তারে জানতে আমার লেখা “মন” বইটি পড়ুন৷ আবেগীয় বা সংবেদনশীল অশ্রুতে মৌলিক ও প্রতিবিম্বের চেয়ে প্রোটিন বেশী থাকে বলে অশ্রু ঘন হয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে ৷ পরিবেশের উপর কান্না যে নির্ভরশীল এতে তা স্পষ্ট ৷ কান্না কোন অপরাধ নয় কিংবা নয়কো লজ্জার ৷কান্না দেখে ভয় পাওয়াও অমূলক ৷ ক্ষণস্থায়ী কান্না পরে ভালো লাগার অনুভূতি আনে ৷ মস্তিষ্ক সজীব হয় ৷ মনোবিজ্ঞানে ভালো কান্নাকে আত্ম পরিষ্কারের ওষুধ বলা হয় ৷ হতাশ রোগীদের কাছ থেকে তাই মনোবিদরা কান্নার বিবরণ শোনেন ৷ চিকিৎসকরা অনেক সময় অশ্রুর উৎপাদন পরিমাপের জন্য চোখ থেকে অশ্রুর উপাদান সংগ্রহ করেন ৷কান্না মানুষের মধ্যে একাধারে গভীর বন্ধন সৃষ্টি করে অন্যদিকে বিতর্কিত পৃথকীকরণ করতে পারে ৷ শোক , দুঃখ , আনন্দ , নিপীড়ন , হিংস্রতা ও সৌন্দর্য বুঝতে কান্নার বিশ্লেষণ কাজে লাগে ৷ দি ক্রাইং বুকের লেখক হিদার ক্রিস্টল বলেছেন কান্নার বিপরীত হাসি নয় গান ৷অশ্রুর রাসায়ণিক গঠন বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে মানব মনের অজানা অনেক কথা আমরা জানতে পারবো বলে একজন চিকিৎসক ও মনোবিদ হিসাবে আমি মনে করি ৷ বিষয়টি আমার রোগী ও পাঠকদের উপকারে এলে খুশি হবো ৷তাই , সঙ্কোচ নয় কবিগুরুর ভাষায় বলি ,” শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে , পড়ুক ঝরে “৷
Be First to Comment