জন্মদিনে স্মরণঃ নটসুর্য অহীন্দ্র চৌধুরী
বাবলু ভট্টাচার্য : চরিত্র চিত্রায়ণে অহীন্দ্র চৌধুরীর সমতুল্য কোন অভিনেতার নামকরা সত্যিই দূরূহ। মঞ্চ বেতার ও চলচ্চিত্র– এই তিন ক্ষেত্রেই অহীন্দ্র চৌধুরী ছিলেন সমভাবে সমুজ্জ্বল।
নাটক সম্পর্কে তার উৎসাহ ছেলেবেলা থেকেই। তাই অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই থিয়েটার, যাত্রা এবং সিনেমা এই তিন মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। তার অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় ১০০। অভিনয়ে অসামান্য দক্ষতার জন্য তিনি সাধারণের নিকট ‘নটসূর্য’ নামে পরিচিত ছিলেন।
১৯২৩ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকালীন অভিনয় জীবনে অহীন্দ্র চৌধুরী বহু নাটকের প্রায় প্রতিটি চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করে নাট্যজগতে একটি যুগের সৃষ্টি করেন, যাকে ‘অহীন্দ্রযুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। ‘প্রিয়তমা’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘তটিনীর বিচার’, ‘রাজনর্তকী’, ‘সোনার সংসার’, ‘ডাক্তার’, ‘শেষ উত্তর’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তার অভিনয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তিনি লন্ডন মিশনারি স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। কিন্তু অল্প বয়সেই অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে তিনি থিয়েটার ও যাত্রাভিনয়ে যোগ দিয়ে এখানে সেখানে শখের থিয়েটার দলে অভিনয় করে বেড়াতেন। ১৯২৩ সালে ‘কর্ণাজুন’ নাটকে তার প্রথম অভিনয়। এছাড়া ‘শ্রীরামচন্দ্র’, ‘অশোক’, ‘চক্রব্যূহ’, ‘সাহজাহান’, ‘মহারাজ নন্দকুমার’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘মিশরকুমারী’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে যে অভিনেতা রণপরিচালক সেনানায়ক সেলুকাসের ভূমিকায় আশ্চর্যভাবে বিশ্বাসযোগ্য, তিনিই আবার ‘শাহজাহান’ নাটকে বৃদ্ধ সম্রাটের অবিকল প্রতিমূর্তি। আবার চিরকুমার সভায় রসিকের ভূমিকায় যখন অভিনয় করেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত চরিত্রটি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তার শেষ অভিনীত নাটক ‘সাহজাহান’ মঞ্চস্থ হয় ১৯৫৭ সালে মিনার্ভা থিয়েটার মঞ্চে। এই নাটকে তিনি নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেন।
মঞ্চের পাশাপাশি অহীন্দ্র চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। ১৯২১ সালে ‘ফটো প্লে সিন্ডিকেট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান যখন তারই লেখা ‘সোল অব দ্য স্লেভ’ চিত্রনাট্যটি চিত্রায়িত করেন, তখন তিনি তাতে ধর্মদাসের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯২২ সালের মার্চ মাসে কর্নওয়ালিস থিয়েটারে ছবিটি মুক্তি লাভ করে।
অহীন্দ্র চৌধুরী ১৯৩১-৫৪ সাল পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি সবাক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যেঃ ‘সোল অব দ্য স্লেভ’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘প্রেমাঞ্জলি’, ‘মিসর রানী’, ‘দুর্গেশ নন্দিনী’, ‘শাস্তি কী শান্তি’, ‘রাজসিংহ’, ‘ঋষির প্রেম’, ‘প্রহলাদ’, ‘বিষ্ণুমায়া’, ‘চাঁদ সওদাগর’, ‘রূপলেখা’, ‘মহুয়া’, ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘ভক্ত কী ভগবান’ (হিন্দি), ‘কবীর’ (হিন্দি/বাংলা), ‘বিদ্রোহী’, ‘কণ্ঠহার’, ‘প্রফুল্ল’, ‘বলিদান’ (হিন্দি), ‘তরুবালা’, ‘কৃষ্ণসুদামা’, ‘পরপারে’, ‘রজনী’, ‘দেবী ফুল্লরা’ ইত্যাদি। তার অভিনীত শেষ ছবি ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ (১৯৭৪)।
১৯৫৪ সালে অহীন্দ্র চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীত-নাটক আকাদেমির অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘গিরিশ লেকচারার’ মনোনীত করে। তার প্রদত্ত বক্তৃতামালা বাংলা নাট্য বিবর্তনে গিরিশচন্দ্র শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তার অপর গ্রন্থ ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ আত্মজীবনীমূলক রচনা।
অভিনয়ে অসামান্য দক্ষতার জন্য ১৯৫৮ সালে সঙ্গীত-নাটক আকাদেমি কর্তৃক তিনি পুরস্কৃত হন এবং নাট্য শতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘স্টার থিয়েটার পদক’ (১৯৭২) লাভ করেন। এছাড়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডি লিট উপাধি প্রাপ্ত হন।
১৯৭৪ সালের ৫ নভেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
অহীন্দ্র চৌধুরী ১৮৯৫ সালের আজকের দিনে (৬ আগস্ট) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment