জন্মদিনে স্মরণঃ মৈত্রেয়ী দেবী
বাবলু ভট্টাচার্য : “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে” অর্থাৎ “শরীরকে হনন করা গেলেও একে হত্যা করা যায় না”। সে ঠিকই রয়ে যায়। সময় বা পরিস্থিতি হয়ত ক্ষণিকের জন্য তার উপর প্রলেপ দিতে পারে কিন্তু দেহস্থিত সেই সত্য অমর। কিন্তু কী সেই বস্তু যা রয়ে যায়- ধর্মীয় রক্ষণশীলদের কাছে যা আত্মা, সত্যান্বেষীদের কাছে সেটাই সত্য, অনুসন্ধিৎসুকের চোখে সেটাই জ্ঞান। আর সেই সত্যকে ধারণ করে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয় এক অসামান্য উপন্যাস ‘ন হন্যতে’। আর আত্মজীবনীমূলক এই গ্রন্থের কথাকার মৈত্রেয়ী দেবী।
মৈত্রেয়ী দেবীর পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত একজন দার্শনিক ও প্রবন্ধকার। মা হিমানী মাধুরী রায়। যদিও তার শৈশব কাটে বরিশালে, পিতার আদিনিবাস বরিশালের আগৈলঝারায়। পরে পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে কৈশোরেই সপরিবারে চলে যান কলকাতার ভবানীপুরে।
একদিকে পিতার আদর্শ আর অন্যদিকে তৎকালীন কলকাতার ‘এলিট’ সম্প্রদায়ের সাহচর্য, মৈত্রেয়ী দেবীর মননে আনে দার্শনিকতার ছাপ। ১৯৩৬ সালে তিনি যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৩৪ সালে কলকাতার ড. মনমোহন সেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মৈত্রেয়ী দেবী। দুটি সন্তানের জনক জননী কাজের সূত্রে হিমালয় ঘেঁষা দার্জিলিং-এর মংপুতে থাকতেন তারা। মংপুতে সিনকোনা চাষের গবেষণায় ড. মনমোহন সেনের বিশেষ অবদান ছিল।
রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্য আর স্নেহে লালিত মৈত্রেয়ী দেবী কবিগুরুকে আমন্ত্রণ জানান মংপুতে বেড়িয়ে যাবার জন্য। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে চারবার অবকাশ যাপনের জন্য মংপুতে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মাত্র ষোল বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উদারতা’ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তছায়া’। মংপুতে কবিগুরুর থাকাকালীন সময়ে কবিগুরুর সাথে তার অন্তরঙ্গ কথোপকথন নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর অনবদ্য গ্রন্থ ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত এ গ্রন্থটি ‘টেগোর বাই ফায়ারসাইড’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
রবীন্দ্র বিষয়ক তার অন্যান্য বইগুলো হল ‘স্বর্গের কাছাকাছি’, ‘কবি সার্বভৌম’, ‘রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: দ্য ম্যান বিহাইন্ড হিজ পোয়েট্রি’।
তবে মৈত্রেয়ী দেবীর জীবনে আলোড়ন তুলেছিল অন্য একটি ঘটনা।
১৯২৮-৩২ সালে ‘নোয়েল এন্ড নোয়েল’ কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ভারতে চাকুরি করতে আসেন রুমানিয়ান নাগরিক মির্চা এলিয়াদ। উদ্দেশ্য চাকুরির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি আর জ্ঞান সাধনা। এবং ঘটনাক্রমে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হয় তখনকার খৃস্টধর্মী ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গ মির্চা।
মৈত্রেয়ী দেবীকে ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়ল মির্চার ওপর। আর মেয়েটিকে দেয়া হলো মির্চাকে ঐ সময়ের কলকাতার বাংলা শেখানোর কাজ। ১৯৩০-সালে ঐ যুগের আধুনিক ও অনন্য ষোড়শী মৈত্রেয়ী এবং রোমানিয়ান তরুণের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনা। তবে এ সম্পর্ক তারা গোপন রাখতেও পারেনি বেশিদিন।
অল্পদিনেই অভিভাবকেরা বিষয়টি জেনে যায়। জাতপাত তথা ধর্মীয় কারণে মির্চাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে এবং আর কখনোই মৈত্রেয়ীর সাথে যোগাযোগ না করতে কঠোরতর নির্দেশ দেয়া হয়।
পরবর্তীতে সেই তরুণই এসব ঘটনাসমূহ নিয়ে লেখেন একটি আধা-আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘লা নুই বেঙ্গলি’ মানে ‘বাংলার রাত’। ইংরেজি নাম ‘বেঙ্গল নাইটস’। আর এই এক বইয়েই তিনি পরিচিতি পান বিশ্বখ্যাত দার্শনিক হিসেবে।
কিন্তু এই উপন্যাসের কথা চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পর জানতে পারেন মৈত্রেয়ী দেবী। ১৯৭২ সালের দিকে লেখকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোলকাতায় এলে অমৃতা জানতে পারেন যে, বইটিতে তাদের দু’জনের প্রেমের সম্পর্কের বর্ণনা করা হয়েছে। প্রায় ষাট বছর বয়সে মৈত্রেয়ী দেবী লেখেন সেই উপন্যাসের প্রতিউত্তর ‘ন হন্যতে’।
মৈত্রেয়ী দেবীকে পাঠক সমাজে এক অনন্য স্থান এনে দেয় ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তার এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। লেখিকার গভীর জীবনবোধ আর নিপুণ দক্ষতায় ব্যক্তিগত প্রেমের কাহিনি, উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়ে, তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। তাই ‘ন হন্যতে’ বাংলা ভাষায় বহুল পঠিত স্মৃতিচারণমূলক এক অসামান্য উপন্যাস।
১৯৭৬ সালে এই বইটির জন্য তিনি ‘সাহিত্য একাডেমি’ পুরস্কার লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, ‘ন হন্যতে’ একাডেমিক পুরস্কারপ্রাপ্ত একালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বইটি ইংরেজি ভাষায় ‘ইট ডাজ নট ডাই’ নামে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনুবাদ করা হয়েছে।
১৯৭৭ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে বক্তৃতা দেয়ার জন্য মৈত্রেয়ী দেবী সোভিয়েত রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও জার্মানিতে গিয়েছিলেন। তার ‘অচেনা চীন’, ‘মহাসোভিয়েত’, ‘চীনে ও জাপানে’ প্রভৃতি গ্রন্থ এ বিষয়ে স্মরণীয়।
দেশ পত্রিকায় লেখা তার ধারাবাহিক ‘চীন দেখে এলাম’ ভ্রমণকাহিনি দেশে সাড়া ফেলেছিল। বিশেষ করে কমিউনিস্ট শাসিত চীনের জীবনযাপন দেশের মানুষকে তখন নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল।
সাহিত্যরচনা ছাড়াও সমাজসেবামূলক কাজে নিবেদিত ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে তিনি ‘কাউন্সিল ফর প্রমোশন অব কমিউনাল হারমনি’ সংস্থা স্থাপন করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সমর্থনে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শরনার্থী শিবিরের অনাথ শিশুদের জন্য তিনি ‘খেলাঘর’ স্থাপন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ সংস্থার কাজকর্ম দেখাশুনা করেছেন।
১৯৯০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মৈত্রেয়ী দেবী।
মৈত্রেয়ী দেবী ১৯১৪ সালের আজকের দিনে (১ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment