Press "Enter" to skip to content

ভূমিপুত্র বাঙ্গালির গাজন, চড়ক ও নববর্ষ উৎসবের প্রেক্ষাপট…..।

Spread the love

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৪ এপ্রিল ২০২২। ছিল রুমাল। হয়ে গেল বিড়াল। ভূমিপুত্র বাঙ্গালির দুই প্রধান লোক উৎসব গাজন ও চড়ক আর নববর্ষ পাল্টে গেলো হিন্দু উৎসবে। বাঙ্গালির পৌষ সংক্রান্তিতে আজও ধর্মের ছোঁয়া লাগেনি। আজও তা হিন্দু মুসলিম,আদিবাসীর কৃষি উৎসব। কিন্তু শৈব ধর্মের ছোঁয়া লেগে গাজন ও চড়ক হয়েছে হিন্দু ধর্মের উৎসব। বাংলার হাল খারাপ হলেও নববর্ষের ১ লা বৈশাখ হয়েছে হিন্দু বাঙালি ব্যবসায়ীর লক্ষ্মী গণেশের পুজোর দিন।

অবশ্য বাংলায় লক্ষ্মী ও গণেশের মন্দির বাড়ন্ত হওয়ায় এই দেবদেবী কালী মন্দিরে আশ্রয় নেন, ব্যবসায়ীর পুজো নিতে। তবে এই দুটি দিন শুধু নয়,সংক্রান্তির আগের দিন নীল পুজোর বঙ্গ ঐতিহ্যও লুপ্ত হয়ে চলেছে। নীল পুজো এক অর্থে নীল ষষ্ঠীর পুজো। মায়েরা উপোস করেন সন্তান এর মঙ্গল কামনায়। এই দেবীও লোক দেবী। পড়ে যা হিন্দু ধর্মে প্রবিষ্ট হয়।

বৃটিশ উপনিবেশের গোলাম হিসেবে বাঙালি বছরের তালিকাকে দিনপঞ্জি না বলে ক্যালেন্ডার বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ক্যালেন্ডার শব্দটি এসেছে ক্যালেন্ডি রোমান শব্দ থেকে। ইতিহাস বলছে, খ্রীষ্ট জন্মের ৩২০০বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে ৫ হাজার ২ শ ২১বছর আগে ক্রো – ম্যাগনন জনগোষ্ঠী মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্যালেন্ডার প্রচলন করে। পোপ গ্রেগরি ১৫৮২খ্রিস্টাব্দে পুরানো রোমান ক্যালেন্ডার সংশোধন করে নতুন ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেন। নাম হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এর আগে ইংল্যান্ড ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বছর শুরু হতো বসন্ত বিষুবের দিনে। যা মার্চ মাসের ২০/২১ তারিখে পড়ত। এই দিনের বৈশিষ্ট্য বছরে এই দিন রাত দিন সমান। ল্যাটিন শব্দ এপ্রিয়ে অর্থ দ্বিতীয়। সেই শব্দ থেকেই এপ্রিল শব্দের উৎপত্তি।

এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু যেহেতু বাংলার দুই লৌকিক উৎসব গাজন, চড়ক এবং নববর্ষ ,তাই সেখানেই ফিরে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত। গাজন।গাজন শব্দের অর্থ গা +জন=গাঁয়ের জন। গাঁয়ের মানুষ। বৃহৎ বঙ্গের ইতিহাস বলছে, ভূমিপুত্র বাঙালি অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের।বেদে যাঁদের বলা হয়েছে মেলেচ্ছ। কেননা মধ্যযুগের শুরু থেকেই বাংলার ভূমিপুত্র কেউই হিন্দু ছিলেন না। সবাই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। অথচ বাংলার বাইরে তখন আর্য সংস্কৃতি হিন্দু ধর্মের বীজ বপন করে চলেছে। কিন্তু প্রায় হাজার বছর বাংলায় যা প্রবেশ করতে পারেনি এখানকার ভূমিপুত্রদের বাধাদানের জন্য। কিন্ত একটা সময় এলো, যখন বৌদ্ধ ভিক্ষু সন্ন্যাসীদের স্খলন আর হিন্দু ধর্মের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সেই বাধা ভেঙে দেয়। বাংলায় রাজনৈতিক অধিকার দখল করেন কর্ণাটক থেকে আসা সেনবংশ। ধীরে ধীরে বুদ্ধদেবের ধ্যানরত মূর্তি বদলে যেতে থাকে শিবের ধ্যানরত মূর্তিতে।

সেই সময়ের বেদবিরোধী দুই ধর্ম গুরু বুদ্ধদেব ও মহাবীরের প্রভাব বিলীন হতে থাকে শিবমূর্তিতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাবলী(অখণ্ড সংস্করণ, সম্পাদনা, সুবোধ চক্রবর্তী, কামিনী প্রকাশনালয়) এ বিদ্যাসাগর লিখেছেন, বৌদ্ধ ধর্ম (মধ্য যুগে) তখন জীর্ণ। স্বপ্নে যেমন এক থেকে আর হয়, তেমনি করেই বুদ্ধ তখন শিব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শিব ত্যাগী, শিব ভিক্ষু, শিব বেদ বিরুদ্ধ, শিব সর্বসাধারণের,,,,,কিন্তু এই শাস্তির দেবতা,ত্যাগের দেবতা টিকল না।পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০। বাংলায় এই দুই ব্যক্তিত্বের উত্থানের আগে থেকেই অবশ্য কিছু লৌকিক দেবতার পূজো ও আচারবিধির প্রচলন ছিল। যা বাংলায় প্রবেশ করেছিল অনার্য দ্রাবিড় সংস্কৃতির প্রভাবে। যেগুলি মূলত টোটেম ও জাদু বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ড: শীলা বিশ্বাস তাঁর ‘ বাংলার ব্রত পার্বণ ‘ গ্রন্থে লিখেছেন_ বৃ ধাতু থেকে (√বৃ+অত, অতক)= ব্রত উৎপন্ন। যার অর্থ সংযম। উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত হিন্দু ধর্মে এই লোকাচার ধর্মের ব্রতপালনকারীদের ব্রাত্যজন হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়টি আরও প্রাঞ্জল করে তাঁর বাংলার ব্রত (১৪০২, পৃষ্ঠা:৫) গ্রন্থে কামনাকারক অনুষ্ঠান বলেছেন। এই কামনাকারক লৌকিক উৎসবের ব্রতকে অনার্য সভ্যতার ধারায় দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।১) শাস্ত্রীয়, পৌরাণিক ২) অশাস্ত্রীয় লৌকিক। এই অশাস্ত্রীয় লৌকিক ব্রতগুলিরও তিনটি ধারা।১) নারী ব্রত,২) পুরুষ ব্রত,৩) পুরুষ নারীর যৌথ ব্রত।কালক্রমে পুরুষ ব্রতগুলির প্রায় পুরোটাই লোপ পেয়েছে। একমাত্র শিবরাত্রির ব্রতই বোধহয় পুরুষরা আজও করেন।আর অন্ত্যজশ্রেণীর পুরুষরা করেন গাজনের ব্রত।নারী ব্রতগুলির অনেকগুলি হারিয়ে গেছে। কিছু আজও মেয়েরা পালন করে। যেমন, ইতুপুজো, শিবরাত্রি, নীলের উপোস।

আবার নারী পুরুষের যৌথ ব্রত গাজন সন্ন্যাস অনেক মেয়েরাই করেন চৈত্রমাসব্যাপী। মধ্যযুগের শুরুতেই বাংলায় ছিল নাথ ধর্মের প্রভাব। নাথ ধর্মের প্রধান নিদর্শন কলকাতার হৃদপিন্ড ধর্মতলা, চৌরঙ্গী। যা ধর্মরাজ ধর্মের উপাসক চৌরঙ্গীনাথের নামে। যিনি কলকাতা নামক গ্রামের শেষপ্রান্তে জঙ্গলে কুটির বানিয়ে ছিলেন। সেটাই আজ কর্মব্যস্ত এসপ্ল্যানেড অঞ্চল।
হাওড়া শহরে আজও আছে ধর্মতলা অঞ্চল। সুখময় মুখোপাধ্যায় তাঁর বাংলার নাথ সাহিত্য (প্রকাশক, সুবর্ণরেখা: কলকাতা ১৯৯৪) গ্রন্থে লিখেছেন,_’…. নাথ ধর্ম মূলত বাংলা তথা পূর্ব ভারতের ধর্ম এবং এই ধর্ম এসেছে বৌদ্ধ মহাযান ধর্ম থেকে। নাথ ধর্মের তিন গুরু।১) জলন্ধরিপা ২) কানুপা ৩) মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ ৷ এই ত্রয়ী গুরু হিন্দু পৌত্তলিক ধারণা ও বুদ্ধদেবের মূর্তির মিশ্রণে বৃহত্তর বাংলায় একটি প্রভাবশালী ধর্মমত গড়ে তোলেন। সেটাই নাথ ধর্ম।
এই হলো গাজন ও চড়কের প্রেক্ষাপট।

ঋগবেদে বাংলার স্থান হয়নি। ড:সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন,বেদের রচনাকাল খৃষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৯০০ অব্দ। বঙ্গ শব্দের প্রথম উল্লেখ মেলে ঐতেরেয় ব্রাহ্মণে। বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে এই সনাতনী ধর্ম গ্রন্থগুলিতে বঙ্গ, মগধ, চের এই স্থানগুলির উল্লেখ রয়েছে মেলেচ্ছস্থান ও পাপভূমি হিসেবে। সুতরাং গাজন বা চড়ক কোনোটাই মূল হিন্দুধর্মের অনুষ্ঠান নয়। সমাজের ব্রাত্যজনের উৎসব। প্রান্তিক মানুষদের উৎসব।গাজনের তিনটি পর্ব।১) ঘাট সন্ন্যাস ২) নীল ব্রত ৩) চড়ক। এই তিন পর্বের সমন্বয়কেই গাজন বলে। কৃষিপ্রধান জীবিকাকে উপলক্ষ্য করেই গাজন। কৃষির মূল উপাদান সূর্যের আলো, মাটি। সূর্যের প্রখর তেজ যাতে নারীরূপী পৃথিবীর উর্বরতার সাহায্যে আসে তাই সূর্যরূপী শিবের সঙ্গে শক্তির অর্থাৎ পার্বতীর মিলন (বিবাহ)রুপক ধর্মী অনুষ্ঠান। কিন্তু মজার বিষয়, চৈত্রে হিন্দু ধর্মে বিবাহ নিষিদ্ধ। সুতরাং বলাই যায় গাজন ও চড়ক বাংলার অন্ত্যজ শ্রেণীর উৎসব। শুরুতে যা হিন্দু উৎসব ছিল না।
এবার দেখা যাক হিন্দু পুরাণ কি বলছে? পৌরাণিক রাজা বাণ ছিলেন দৈত্যরাজ বলির শত পুত্রের শ্রেষ্ঠ নরপতি। মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করায় মহাদেবের নির্দেশে তিনি তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন শোণিতপুরে। সম্ভবত শোণিতপুর বর্তমান আসামের গুয়াহাটি থেকে কমবেশি ২৫০ কিলোমিটার দূরে। কৃষ্ণভক্ত প্রহ্লাদ ছিলেন রাজা বাণ এর প্রপিতামহ। শিবভক্ত বাণ ছিলেন বিষ্ণু বিরোধী।(আর্য বিরোধী?)। ফলে বাণ রাজার অন্ত্যজ প্রজাদের উৎসব হয়ে ওঠে শিবব্রত গাজন ও চড়ক। মূলত রাঢ় বঙ্গের জেলাগুলিতেই এই উৎসব পালিত হয়।

বর্ধমানের কুড়মুন, উদ্ধারণপুর, বেগুনকোলা, শাঁখারিশিল্লা, গোপালপুর, দাঁইহাঁটি, পাচুন্দি প্রভৃতি গ্রামের চড়ক উৎসব উল্লেখযোগ্য। গ্রাম ভেদে উৎসবের প্রথাও ভিন্নভিন্ন। কুড়মুনের গাজনে মড়া মানুষের খুলি নৃত্য যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই শিল্লার গাজনে বলি দেওয়া ছাগলের রক্তপান। আজ অবশ্য সর্বসমক্ষে তার দেখা মেলে না। ইতিহাস বলে, বাংলায় সবচেয়ে বেশি গাজন উৎসব পালিত হয় মেদিনীপুরে। দুই বিভক্ত জেলার কোথাও চৈত্র মাসে কোথাও বা বৈশাখ মাসে গাজনপর্ব পালিত হয়। উল্লেখযোগ্য স্থানগুলি হলো _মেদিনীপুর শহর, শালবনি, কেশপুর, ডেবরা, তমলুক, পাশকুঁড়া, নন্দীগ্রাম, রামনগর, চন্দ্রকোনা, ঝাড়গ্রাম ও কাঁথি সহ বিভিন্ন অঞ্চল।
পুরুলিয়ায় প্রবাদ, গাজনের ঢাকে কাঠি পড়লেই নাকি সজনে ডাঁটা ফাটতে শুরু করে। এই জেলায় রোদ যত চড়ে, মেলা তত জমে। হাওড়ার বাগনান থানার বাইনান গ্রামের শিবহটনাক্ষের গাজন উৎসব সুপ্রাচীন। চড়কের আগের দিন নীলষষ্ঠীতে হয় নীল পুজো।

সন্ধেতে শিবের মাথায় ১০৮ ঘড়া জল ঢালা হয়। বিয়ে হয় লীলাবতীর (পার্বতী) সঙ্গে। আগেই বলেছি,সমাজের ব্রাত্যশ্রেণীর উৎসব চড়ক। চৈত্র মাস জুড়েই নতুন গৈরিক বস্ত্র ও গামছা পড়ে উপবাসে থাকতে হয়। সারাদিন ঘুরে ভিক্ষান্ন ও পয়সা ভিক্ষা করে পথে পথে ঘুরতে হয় ব্রত পালনকারীদের। মুখে থাকে একটি বুলি। ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে।’ সন্ধায় ভিক্ষান্ন মাটির মালসায় হবিসান্ন্য গ্রহন, মাটিতে শুয়ে কৃচ্ছ সাধন।
চৈত্র সংক্রান্তির ভোরে আগুন বা হাতাবাণ। লোহার তৈরি প্রায় তিন ফুট দৈর্ঘ্যের দুটি হাতা কোমরের দুদিকে ব্রতধারণকারীর বেঁধে দেওয়া হয়। হাতায় থাকে ঘি। জ্বলে আগুন। এরপর হাকুন্ড বাণ। পুরোহিতের মন্ত্রে অচেতন হন ভক্ত। বাজতে থাকে ঢাক। বলা হয় প্রাচীন লোকগাঁথা। ‘শিব বেটা বোয়া, বউয়ের হাতে ভাত খেয়েছেন, পেট করেছেন লেও (ভুঁড়ি)।’ ভক্ত ব্রতধারণকারী ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেলে জিভে বেঁধা হয় বাণ। যা লোহার তৈরি। দুপুরে কাঠাবাণ। তাতে শয়ন। অনেকটাই ভীষ্মের শরশয্যার মতো। নীলপুজোর দিনে ব্রতধারী ভক্ত পড়েন হলুদ কাপড়। স্নান করেন হলুদ জলে। গলায় ঝোলাতে হয় গুলঞ্চ ফুলের মালা। বিকেলে পিঠের চামড়ায় বিশেষ উপায়ে আঁকশি গেঁথে চড়ক গাছে অর্থাৎ কাঠের তৈরি চরকিতে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ভক্ত ব্রতধারীকে। তাঁর ঝোলায় থাকে ভিক্ষায় পাওয়ায় ফলমূল, বাতাসা, ফুল, মালা। ভক্তদের ধারণা, বাবা তারকনাথের কৃপায় শরীরের ঘা আপনি শুকিয়ে সেরে যায়। যা একান্ত বিশ্বাস।

এই ভয়ঙ্কর প্রথায় বহু ভক্তের প্রাণও গেছে। তবু বিশ্বাস।যুক্তিবাদীদের চোখে অন্ধবিশ্বাস।
কলকাতার উত্তরে গিরীশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের কাছে ছাতুবাবু লাটু বাবুদের বাজার। সেখানে আজও বিকেলে ব্রতপালনকারী গাজন সন্ন্যাসীরা চড়কে ঘোরেন বনবন করে। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালির ইতিহাস আদিপর্বে লিখেছেন_….. ধর্ম পূজা সম্বন্ধে যাহা সত্য, নীল বা চড়ক পূজা সম্বন্ধেও তাহাই। এই চড়ক পূজা এখন শিবের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জড়িত। ড: বারিদবরণ ঘোষ সংকলিত ‘বুদ্ধ ও বৌদ্ধ’ গ্রন্থে বুদ্ধদেব সম্পর্কিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘,,,,, সামাজিক জনতত্ত্বের দৃষ্টিতে ধর্ম ও চড়ক পূজা দুইই আদিম কোম সমাজের ভূতবাদ ও পুনর্জন্মবাদ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক কোমের মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জন্মের কামনাতেই এই দুই পুজোর বাৎসরিক অনুষ্ঠান। তাহা ছাড়া বানকোঁচ এবং দৈহিক যন্ত্রণা গ্রহন বা রক্তপাত উদ্দেশ্যে যেমন অনুষ্ঠান চড়ক পূজার সঙ্গে জড়িত তাহার মূলে সুপ্রাচীন কোম সমাজের নরবলির প্রথার স্মৃতি বিদ্যমান।’ এই গ্রন্থে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর লিখিত প্রবন্ধে বলেছেন ‘,,,,,,,, বাংলায় ধর্ম ঠাকুরের পূজাই হয়ত বৌদ্ধ ধর্মের শেষ অবস্থা।’ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে করেন, ধর্ম ঠাকুর শিবও নন, বিষ্ণুও নন, ব্রহ্মাও নন।
চড়কের আগের দিন নীল পুজো। পালন হয় নীল ষষ্ঠীর ব্রত। প্রধানত মেয়েরাই এই পুজোয় উপবাস করেন। এক সাময়িক পত্রে নবনীতা দেবসেন লিখেছেন’,,,,,,,,,, মামিমা জবরদস্তি নীল পুজো করতেন আমাকে দিয়ে।,,,,,, চৈত্র মাসে তিনদিন থাকতে ব্রত শুরু হতো।,,,,,,,, নিজে এই ব্রত পালন না করলেও মামিমার ইচ্ছেতে মা বাধা দিতেন না। আমাকে খুব সকালে তুলে দিতেন। মুখ ধুয়ে বাসি পোষাক ছেড়ে ছুট ছুউট মামার বাড়ি। সেখানে ঠাকুর ঘরে মস্ত এক থালায় ভিজে নরম গঙ্গা মাটি রাখা থাকত। তাই দিয়ে বুড়ো আঙ্গুলের মত খুদে খুদে শিব ঠাকুর কেমন করে গড়তে হয় মামিমা শিখিয়ে দিতেন। পুজোর শেষে তিনদিনের ফুল বেলপাতা একটি ঝুড়িতে জমা করে রেখে দেওয়া হতো।বৈশাখ মাস কেটে গেলে সবগুলো শুকনো ফুল বেলপাতা আর শিব লিঙ্গ নিয়ে ঝুড়ি শুদ্ধু গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসতেন পুরুত ঠাকুর।’


মূল হিন্দুধর্মে বুদ্ধদেবকে রাখা হয়েছে বিষ্ণুর নবম অবতারে। বেদে তো তুমুলভাবে শিবনিন্দা আছে। প্রজাপতি দক্ষের (সতীর পিতা) শিবনিন্দার দাপটে তো সতী দেহত্যাগ করেছেন । সেকথা কার না জানা? তাছাড়া বরাহপুরাণ ও পদ্মপুরাণের শ্লোকে ছত্রে ছত্রে রয়েছে শিব বিদ্বেষের কথা। বলা হয়েছে, শৈব মতবাদ পাষণ্ডের মতবাদ। পশুদের শাস্ত্র। (পশুপতি) পাপীরা শিব ভক্তি করে। পরে অবশ্য আধ্যাত্বিক রাজনীতির প্যাঁচে হরিহর আত্মার ব্যাখ্যা করে শিবকে হিন্দু ধর্মে ঢোঁক গিলে মেনে নিতে। হয়েছে। তাই চৈত্র সংক্রান্তির গাজন ও চড়কের পাবন অন্ত্যজের উৎসবেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল।
আগামীকাল প্রসঙ্গ বাংলা নববর্ষ এবং লক্ষ্মী গণেশ পুজোর শুরুর কথা

More from CultureMore posts in Culture »
More from GeneralMore posts in General »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.