ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : ৩ নভেম্বর ২০২১। দীপাবলির আগের দিন ” ভূত চর্তুদশী ” যার সঙ্গে ১৪ সংখ্যাটি ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত ৷ এইদিন দুপুরে আমরা ১৪ রকম শাক ভাজা খাই ৷ সন্ধ্যায় ১৪ টি প্রদীপ জ্বালিয়ে ভূত তাড়াই ৷ আবার ১৪ পুরুষকে স্মরণ করি। ঋতু পরিবর্তনের সময় ১৪ শাক খাওয়ার ওষুধি গুণ রয়েছে ৷এর পিছনে আয়ুর্বেদ সম্মত ব্যাখ্যা আছে – এই সময় যেহেতু ঠান্ডার আমেজ এসে যায়, হাওয়ায় ভাসে হিম, দিনে গরম রাতে ঠান্ডা যা থেকে নানারকম রোগ সৃষ্টি হয়, তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ানোর জন্যে এই চোদ্দশাক খাওয়ার প্রথা। বাজারে প্রচলিত যে শাকগুলো খেলেও সমান উপকৃত হবেন এমন ১৪ টি শাক ও খেতে পারেন। শাক গুলো হলো পালং শাক, লাল শাক, সুষণি শাক, বেতো শাক, কালকাসুন্দা, পুঁই শাক, কুমড়ো শাক, গুলঞ্চ শাক, মূলো শাক, কলমি শাক, সরষে শাক, নোটে শাক, মেথি শাক, লাউ শাক অথবা হিঞ্চে শাক৷
আয়ুর্বেদ বা কবিরাজি শাস্ত্রে এই ১৪ শাকের গুণ অসীম৷ ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ের নানা রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে আমাদের শাস্ত্রে ১৪ শাক খাওয়ার প্রচলন হয়েছে । কোন শাক কী রোগ প্রতিরোধ করে আপনাদের জন্য রইলো সেই জরুরি তথ্য৷ নীচে শাকগুলি সম্বন্ধে বিস্তারিত দেওয়া হলো ::–

১. বেতো শাক কৃমিনাশক, কোষ্ঠবদ্ধতা ও অম্বল প্রতিরোধক। বেতো বা বাস্তুক শাক চৈতন্য চরিতামৃত মতে ভগবানে ভক্তি বাড়ায় ৷
২. কালকাসুন্দে -অ্যান্টি-অ্যালার্জিক, কোষ্ঠবদ্ধতা, অর্শ, ফিসচুলা, হুপিং কাশি, দাদ ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়৷
৩. নিমের উপকারিতা অনেক , বিশেষতঃ চর্মারোগে ৷ ম্যালেরিয়া, জন্ডিস, এইডস, কুষ্ঠতে ৷ এছাড়া, কৃমি, খোস-পাঁচরা, ক্ষত, স্বপ্নদোষ নির্মূল করে৷
৪. জয়ন্তী শাক বহুমূত্র, শ্বেতী , জ্বর এবং কৃমি নাশকের কাজ করে৷ সদ্য প্রসূতিদের জন্য খুব উপকারী৷ কাঁচা সর্দ্দিতে উপকারী ৷
৫. গুলঞ্চপাতার রস সেবনে কুষ্ঠ, বাতরক্ত, জ্বর, পিত্তদোষজনিত বিকৃতি ও কৃমিরোগ নষ্ট হয়৷
৬. সুষনি শাক হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ এবং মানসিক অস্থিরতা কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। নার্ভের সমস্যা দূর করে ৷ ঘুম আনে ৷
৭. পলতা পাতা বা পটলের শাক, এই শাক যে কোন শ্বাসের রোগে কার্যকরী। এরা রক্তবর্ধক এবং লিভার ও চামড়ার রোগ সরাতে এদের প্রভূতভাবে ব্যবহার করা হয়। পিত্ত রোগে অতুলনীয় ৷
৮. হিঞ্চে শাকে ফাইটোস্টেরল সহ বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক পদার্থ থাকে। হিঞ্চে খেলে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ে। শুধুমাত্র পিত্তনাশক হিসাবেই নয়, রক্তশোধক হিসাবে, ক্ষুধাবর্ধক এবং জ্বর নির্মূলকারী হিসাবে এর ব্যবহার অপরিসীম৷
৯. পালং শাক জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এই শাক বিশেষ উপকারী। পোড়াঘায়ে, ক্ষতস্থানে, ব্রণে বা কোথাও ব্যথায় কালচে হয়ে গেলে টাটকা পালং পাতার রসের প্রলেপ লাগালে উপকার পাওয়া যায়। পালং শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি, ই এবং আয়রন। এজন্য পালং শাক খেলে রক্তে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়।
১০. লালশাক ভিটামিন ‘এ’-তে ভরপুর। লালশাক নিয়মিত খেলে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে এবং অন্ধত্ব ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করা যায়। এটি শরীরের ওজন হ্রাস করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
১১. পুঁইশাকে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন। তবে ভিটামিন ‘বি’, ‘সি’ ও ‘এ’-এর পরিমাণই বেশি। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে আছে ক্যালসিয়াম এবং আয়রণ। এই শাক কিছুটা গুরুপাক। তাই আমাশার রোগীদের তা না খাওয়া উচিত। রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমান বেশি থাকলে বাতজনিত সমস্যা দেখা যায়। যাদের এই সমস্যা আছে তাদেরও বর্জন করা উচিত পুঁইশাক। এতে প্রচুর আঁশ আছে বলে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা দূর করে।
১২. কলমি শাকে ক্যালসিয়াম থেকে বলে এই শাক হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও কলমি শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, পর্যাপ্ত পরিমানে লৌহ, থাকায় এই শাক রক্ত শূন্যতার রোগীদের জন্য দারুন উপকারি।
১৩. নোটে শাক পিত্তনাশক, রক্ত পরিষ্কার করে ও মেদ কমায়৷
১৪. মেথি শাকের গুরুত্ব অপরিসীম৷ এই শাক তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে৷ হতাশা কাটাতে ও ডায়বেটিসের জন্য মেথি শাক খুব উপকারি৷ এছাড়া, যৌনক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এই শাক৷ যমের ১৪ টি নামে চোদ্দো শাকের নাম ৷
যম, ধর্মরাজ , মৃত্যু , অন্ত , বৈবস্বত , কাল , সর্বভূতেশ্বর , ঔড়ম্বর , দধ্ন , নীল , পরমেষ্ঠী , বৃকোদর , চিত্র, এবং চিত্রগুপ্ত ৷
শাস্ত্রীয় ধারণা এই দিনে প্রেতলোক থেকে আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসে। যে সব আত্মারা প্রেতলোক প্রাপ্ত হয়। যারা স্বর্গ বা নরক কোনটাতেই যেতে পারে না, তারা এই দিনে পৃথিবীর পরিচিত মন্ডলে ফিরে আসে ৷ এই একটিদিনে তাঁদের আলো দেখানো হয়, এতে তারা আনন্দিত হয়। এটা হিন্দুদের আমাদের এই দেহ পঞ্চভূতের সমষ্টি। আকাশ, ভূমি, জল, অগ্ধি , ও বায়ু ৷ অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ৷ রোগ থেকে আরোগ্যের পথে যাওয়াই চোদ্দ শাকভাজা খাওয়ার কারন ৷
দেহান্তে শ্মশানে দেহ দাহ হলে এই শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়। সুতরাং এই পঞ্চভূতের শরীরকে নশ্বর জ্ঞানে এই দিনটি পবিত্র ভাবে থেকে চোদ্দশাক খাওয়ার প্রথা এসেছে ৷পরলোকের অধিপতি “যম”,
ধর্মগ্রন্থে আছে এই কার্তিকের টানের সময়ে যমালয়ের আটটি দরজা খোলা থাকে ৷ তাই ,শরীর সুস্থ রাখার জন্য ১৪ শাক খাওয়া চালু হয় ৷
” হিন্দুদের ভূত চর্তুদশী আর খ্রিস্টানদের হ্যালোউইন “! …. প্রায় একই সময়ে দুই সম্প্রদায় ভূত – পেত্লি
বা প্রেতাত্মাদের তুষ্ট করার এমন উৎসব পালন করে ৷ কার্তিক মাসের অমাবস্যার কালীপুজো বা দেওয়ালীর ঠিক আগের দিন বা ধনতেরাসের পরের দিন আমরা বাঙালি হিন্দুরা পালন করি “ভূত চর্তুদশী ” !
অন্য জায়গাতেও হিন্দুরা কৃষ্ণ পক্ষের এই ১৪তম দিনে রামচন্দ্রের ১৪ বছর বনবাসের স্মরণে প্রদীপ বা বাতি জ্বালায় ৷ এইদিন দুপুরে আমরা ১৪ শাক খাই ৷ যা স্বাস্থ্য সম্মত ৷ বিভিন্ন জায়গায় রকমফের থাকে শাকের ৷ আমরা বেতো , সরষে , শুষনি , ভাঁট , নিম , ওল , জয়ন্তী , হিলঞ্চে , পলতা , কালকাসুন্দে ,মূলো , পালং , নটে ও সজিনা শাক মিশিয়ে খাই ৷ আগে বাড়ীতে মাটির
প্রদীপ তৈরী করে সন্ধ্যায় আলো জ্বালানো হত ৷ ধর্মরাজ বা যমকে উদ্দেশ্য করে যম প্রদীপ দেওয়া হত ৷ এখন মোমবাতি , প্রদীপ ইত্যাদিও জ্বালানো হয় ৷
মনে করা হয় এদিন উদ্ধর্তন ১৪ পুরুষ জীবিতদের
কাছে আসেন ৷ ঠিক এক মাস আগের মহালয়ার মত এটাও মৃতদের স্মৃতিতর্পণ বলা যায় ৷ বাড়ির সবদিক আলোকিত করা হয় ভূত তাড়াতে ৷ সারা পৃথিবীতে ৩১ অক্টোবর পালিত হয় এমনই এক উৎসব হ্যালোউইন (Helloween) বা অল সোলস ডে বা প্রেতাত্মার দিন বা অল হ্যালোস ইভ বা অলসেইন্টস ইভ ৷ পৌত্তলিক রোমানদের থেকে সারা বিশ্বে খ্রিস্টানদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়েছে ৷ ডাইনি , জম্বি , ভ্যাম্পায়ার , ওয়াউলভস , প্রেতাত্মাদের জন্য ৷ নিশীথ রাতে কুমড়োর ভিতরে নাক , চোখ , মুখ করে হ্যালোউইন বা হ্যালোইন পালন করা হয় ৷ এইদিন অনেকে আবার ভূত সাজে ৷
Be First to Comment