জন্মদিনে স্মরণঃ মু ল ক রা জ আ ন ন্দ
“একটা জাতি না খেতে পেলেও উঠে দাঁড়ায়, যদি তার বুকের গভীরে সংস্কৃতিটা থাকে।”
———- মুলক রাজ আনন্দ
বাবলু ভট্টাচার্য : ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে যে কজন প্রতিভাবান লেখক ক্ষুরধার লেখনী চালিয়েছেন মুলকরাজ আনন্দ তাদের একজন। আধুনিক জীবনের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে বিশেষত ব্রিটিশ শাসন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত ছিলেন।
তাঁর রচনায় কৃষক, মজুর, কুলি থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত জীবনের এমন চরিত্র নেই, যা তাঁর গল্প উপন্যাসে কলমের খোঁচায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেনি। অবশ্য তাঁর রচনার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মানবতা। মানবতার জয়গান গেয়েছেন তিনি তাঁর গল্প ও উপন্যাসে।
পিতার আদি নিবাস অমৃতসর। তিনি এমন এক পরিবারে প্রতিপালিত হয়েছেন, যারা গ্রামীণ জীবন থেকে ক্রমশ আধুনিক ইংরেজ জীবনধারার দিকে ধাবিত হয়েছেন। ফলে বাল্যকাল থেকে আনন্দ জীবন ও সমাজ সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন।
যৌবনে তিনি দেখেছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য তিনি কিছুদিন কারারুদ্ধ ছিলেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
কবি ইকবালের সামান্য বৃত্তিকে সম্বল করে মুলকরাজ আনন্দ লাহোর থেকে লন্ডন যাত্রা করেন৷ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। পরে প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৪ সালে ভারতে ফিরে এসে গান্ধীজীর আশ্রমে কিছুদিন অবস্থান করেন।
১৯৩৫ সালে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘অচ্ছুত’ রচনার কাজ শেষ করেন। তারপর একে একে বিখ্যাত উপন্যাস — ‘কুলী’, ‘উদার হৃদয়’, ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’, ‘সাতটি গ্রীষ্ম’, ‘বীরের মৃত্যু’, ‘ভারতীয় যুবরাজের গোপন জীবন’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশের ফলে তার খ্যাতি সাহিত্য জগতে ছড়িয়ে পড়ে।
আবার পণ্ডিত নেহেরুর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য লন্ডন গমন করেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি সাজ্জাদ জহীরের সঙ্গে ভারতীয় প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন।
মুলকরাজ আনন্দ ভারতে ফিরে প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। তিনি ১৯৩৬ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৩৭ সালে স্পেনে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্মেলনে অংশ নেন।
১৯৪৬ সালে ভারতে ফিরে তিনি ‘মার্গ’ নামে একটি ললিতকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক সাময়িকী প্রকাশ করেন। তিনি সাহিত্য সাধনার জন্য অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৫২ সালে ভিয়েনা বিশ্বশান্তি কাউন্সিল পুরস্কার, ভারত সরকারের পদ্মভূষণ উপাধি এবং ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
সিমলার ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসাহিত্য বিষয়েও পড়াতেন তিনি।
তার সবকটি উপন্যাস, ছোটগল্প ইংরেজি ভাষায় রচিত। রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি তার মধ্যে ১১টি ছোটগল্প সংকলন। তার রচিত উপন্যাস-গল্প ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে মুলকরাজ আনন্দ একটি সুপরিচিত নাম।
২০০৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন।
মুলকরাজ আনন্দ ১৯০৫ সালের আজকের দিনে (১২ ডিসে) পেশোয়ারে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment