স্মরণঃ চা র ণ ক বি মু কু ন্দ দা স
“হাসি হাসি পরবো ফাঁসি, দেখবে জগৎবাসী
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।”
[ চারণকবি মুকুন্দ দাস ]
বাবলু ভট্টাচার্য : ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝড়তোলা চারণকবি মুকুন্দ দাস।
তার এই গান আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
মুকুন্দ দাসের জন্ম মুনশীগঞ্জ বা বিক্রমপুরের বানাড়ি গ্রামে ১২৮৫ বঙ্গাব্দে। বাবা-মায়ের দেয়া নাম যজ্ঞেশ্বর। পদ্মা নদীতে বানাড়ি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে বাবা গুরুদয়াল দে সপরিবারে বরিশাল চলে যান এবং ডেপুটির আদালতে আরদালির চাকরি নেন।
১৯ বছর বয়সে বীরেশ্বর গুপ্ত নামে এক বৈষ্ণবের কণ্ঠে গান শুনে একটি কীর্তনের দল গঠন করেন। ১৯০২ সালে রামানন্দ গোঁসাইজী বা হরিবোলানন্দ নামে এক ত্যাগী সাধুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
১৮৯৫ সাল। যজ্ঞেশ্বর তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। কোথায় কার শবদেহ কবর দিতে হবে, শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে-হোক সে হিন্দু অথবা মুসলমান অথবা খৃষ্টান- যজ্ঞেশ্বর সেখানেই হাজির। তাই তার নাম হয়েছিল ‘মরাপোড়া যগা’।
অশ্বিনী কুমারের পরামর্শে তিনি প্রয়াত কীর্তনগুরু বীরেশ্বর গুপ্তের ভাঙা দলটি নিয়ে গুরুর পরামর্শ মতো স্বদেশী যাত্রা দল গঠন করলেন মুকুন্দ দাস।
অশ্বিনী দত্তের আহবানে স্বদেশী চেতনা যাত্রাপালা আকারে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিলেন মুকুন্দ দাস। লিখলেন মাতৃপূজা যাত্রাপালা। মাতৃপূজা মঞ্চস্থ হল জোড়সাকো ঠাকুর বাড়ি, বেলেঘাটা, মানিকতলা রঙ্গ মঞ্চে ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। স্বয়ং কবিগুরু মুগ্ধ হলেন এই যাত্রা পালা দেখে।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ পরিকল্পনা প্রকাশিত হলে সর্বত্র এর প্রতিবাদ হয়। স্বয়ং কবিগুরু রাখী বন্ধনের মাধ্যমে বাংলা ভাগের প্রতিবাদ করেন। অশ্বিনী দত্তের নেতৃত্বে বরিশাল হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। মুকুন্দ দাশ স্বদেশী যাত্রাপালা নিয়ে গ্রামে গ্রামে জাগরণের গান গাইলেন। অবস্থা এমন হলো মুকুন্দ দাশ যেখানে যেতেন বৃটিশ রাজ সেখানেই ১৪৪ ধারা জারি করতেন। ১৯০৮ সালে দুইবার গ্রেপ্তারের পর ১৯১০ সালে তিনি দিল্লী থেকে ছাড়া পান।
অশ্বিনীকুমার দত্তের কাছে স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পরেই মন্ত্রগুরু রামানন্দ স্বামী তাকে ‘মুকুন্দ দাস’ নাম দেন। এরপর চারণ কবিরূপে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। সঙ্গীত ও নাটকের রচয়িতা মুকুন্দ দাস বরিশাল হিতৈষী পত্রিকায় লিখতেন। যাত্রাগানে সমগ্র বরিশাল মাতিয়ে রাখতেন।
কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথাক্রমে ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে চারণ-সম্রাট মুকুন্দ’ উপাধিতে ও ‘সন্তান’ আখ্যায় ভূষিত করেন তারা।
অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলনকালে যাত্রাপালা গেয়ে জনসাধারণের মনে কৃষক-মজুর, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমারসহ ভারতকে ইংরেজ শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করার বাণী তার গান ও যাত্রাপালায় শাণিত অস্ত্রের মতো প্রেরণা জোগাত।
বিভিন্নভাবে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি বরিশালের কাশীপুর কালীমন্দিরের জায়গা কেনেন। যা এখন বরিশালে চারণকবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে ছাত্রাবাস, লাইব্রেরি, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পুজামন্দির। মুকুন্দ দাসের স্মৃতিরক্ষায় এখন ওইটুকুই বরিশালে সবেধন নীলমনি হয়ে আছে।
মুকুন্দ দাস রচিত গ্রন্থ : সাধনসঙ্গীত, পল্লীসেবা, ব্রহ্মচারিণী, পথ, সাথী, সমাজ, কর্মক্ষেত্র প্রভৃতি।
অনেক মেডেল ও পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। জনগণের কাছে ‘চারণ কবি’ নামেই সমধিক পরিচিত।
চারণ কবি মুকুন্দ দাস ১৯৩৪সালের আজকের দিনে (১৮মে) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment