” বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস “৷
(” WORLD PRESS FREEDOM DAY ” .)
————————————————————-
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ৩ মে ২০২২। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬ তম সাধারন অধিবেশনের সুপারিশে রাষ্ট্রসংঘ ১৯৯৩ সাল থেকে ৩ মে এই দিবস পালনের ডাক দেয় ৷সেই থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে সাংবাদিকরা এই দিবসটি পালন করে আসছে ৷ একসময় এই প্রতিবেদকের পেশা ছিল সাংবাদিকতা ৷ তাই , আজও এই দিনটি প্রতিবেদকের মনে ব্যাপক ভাবে সাড়া ফেলে ৷ কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের ফলে আজ সেভাবে এই প্রতিবেদক অংশ নিতে পারেন না ৷ বিশ্বের যেখানে যেখানে যখনই কথা বলা ও লেখার স্বাধীনতায় সরকার / ক্ষমতাসীন মহল থেকে বিদ্রোহীরা পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে তখন প্রতিবেদকের ইচ্ছা হয় সোচ্চারে প্রতিবাদ করি ৷ প্রায় সব দেশের সংবিধানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা , সংবাদপত্র , বেতার , টিভি , ডিজিটাল গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও প্রায় সর্বত্র কম বেশী তা ভূলুন্ঠিত হচ্ছে৷ নানা চাপে গণমাধ্যম দিশাহীন হয়ে উঠছে ৷ মুক্তচিন্তা সাংবিধানিক অধিকার ৷ অথচ , কখনো রাষ্ট্র , কখনো পুলিশ , ছাত্র , দুর্বৃত্ত , পেশিশক্তি থেকে ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হচ্ছেন গণমাধ্যম কর্মীরা ৷ অনেক সময় মালিক পক্ষ আপোষ করায় কর্মীদের পিছিয়ে আসতে হচ্ছে ৷ সাংবাদিকরা পড়ছেন রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের রক্তচক্ষুর করলে ৷ মিথ্যা মামলা , লোক দেখানো বিচারের কবলে পড়তে হয় ৷ অথচ , সাংবাদিকদের দুরূহ কাজের সুফল সবাই পেয়ে থাকেন। আরো সচেতন ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সাংবাদিকদের তাই কাজ করে যেতে হবে ৷ ইউক্রেন -রুশ যুদ্ধে ঘরে বসে জীবন বাজি রেখে করা প্রতিবেদন প্রতিটি মানুষ ঠান্ডা ঘরে বসে চা খেতে খেতে উপভোগ করেন ৷ এই দিবসটি কে সামনে রেখে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার দাবী জানায় শতাধিক আর্ন্তজাতিক সংগঠন ৷ সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতি অনুসরণ , পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও এলাকায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন , মুক্তচিন্তা , পেশাগত অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাঁদের স্মৃতিচারণ , সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় এই দিনটিতে ৷
এই দিবসটিতে প্রতিবার কোন না কোন থিম থাকে৷ ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় “ডিজিটাল শৃঙ্খলে সংবাদমাধ্যম “৷ ইউনেস্কোর উদ্যোগে এবারের মূল আয়োজক দেশ লাতিন আমেরিকার “উরুগুয়ে “৷ এবারে রাষ্ট্রসংঘ ও উরুগুয়ে যৌথ উদ্যোগে মূল অনুষ্ঠানটি করছে ৷ যাতে সরাসরি ও ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিচ্ছেন বিশ্বের মুক্ত গণমাধ্যম আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা ৷ গতবছর ২০২১ সালের থিম ছিল ,”তথ্য জনগণের পণ্য “৷ ২০২০সালের শ্লোগান “ভয় বা পক্ষপাতিত্বহীন সাংবাদিকতা ” ৷২০১৯ এর থিম ছিল আমাদের কামনা “মুক্ত হোক জাগ্রত কন্ঠ “৷ আমাদের প্রত্যাশা সবরকম কালো আইন , বাধা দান ও হুমকির হোক অবসান ৷ আসলে পারিপার্শ্বিক জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে জানার স্বাধীনতা নিয়েই মানুষের জন্ম ৷ তথ্যের অধিকার বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তাই শুধু কোনো শ্রেণিবিশেষের নয় গণমানুষের অধিকার ৷ ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬ তম সাধারণ অধিবেশন ঠিক করে ৩ মে তারিখটি সারা পৃথিবীতে “বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ” বা World press freedom day” পালিত হবে ৷ ভারতে করোনা কালে ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ করতে গিয়ে ১৭৪ জন সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের করোনা পরীক্ষা করে ৫৬ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে ৷ কলকাতায় পরীক্ষা করা হয়নি ৷
এই প্রতিবেদকের বন্ধু বাংলাদেশের সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকন কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৷ আজ যেন আমরা এইসব ত্যাগী সাংবাদিকদের
স্মরণ করি ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই ৷ ২০২০তে তাই আলোচিত বিষয় করা হয়েছে ” Journalism without fear and fever ” ৷ গণমাধ্যমের দুর্দিন ,
অনিশ্চয়তা ও সঙ্কট কাটাতে এর তাৎপর্য অপরিসীম ৷
২০১৯ এ ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা
তে ইউনেস্কোর উদ্যোগে তিন দিন ধরে এক আর্ন্তজাতিক সম্মেলন হয়েছিল ৷ যেখানে বলা হয়
“গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া সুন্দর দেশ বা সমাজ গঠন কোনো ভাবেই সম্ভব নয় “৷ ২০১৮ তে বিষয় ছিল “শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণ মূলক সমাজের অগ্রগতিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা ” ৷ কিন্তু , সরকারী প্রশাসনের
রক্তচক্ষু , জঙ্গিবাদ , মাফিয়া রাজ ও কালোবাজারী দের দাপটে এবং কতৃপক্ষের স্বার্থরক্ষা , কর্পোরেট সাংবাদিকতা , বিজ্ঞাপন দাতা , প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের অঙ্গুলীহেলনে তা কতখানি সম্ভব হচ্ছে ?নাকি সাংবাদিকদের স্মৃতিচারণেই কি দিনটা সীমাবদ্ধ থাকবে ? পেশা গত দায়িত্ব পালনে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারীর সংখ্যা তো কমছে না ৷ ২০১৮ সালে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সারা বিশ্বে ৯৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছিলেন ৷ আমেরিকার ক্যাপিটাল গেজেট পত্রিকায় বন্দুকবাজের হামলায় ৫ জন মারা যান ৷ সেবারে তুরস্কে সৌদি সাংবাদিক খাসোগির হত্যা সবচেয়ে ঝড় তোলে ৷ ২০১৭ সালে সারা পৃথিবীতে ৫৩০ জন সাংবাদিককে জীবন দিতে হয়েছে ৷ শুধুমাত্র সিরিয়াতেই ৮৬ জন , আর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ আমাদের ভারতে ৫ জন ৷ ফ্রান্স ভিত্তিক রির্পোটারস উইদাউট বর্ডারস ( RSF) বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে ৷ ১৮০টি দেশের মধ্যে গতবারের ১৫২তম স্থান থেকে ১০ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ এখন ১৬২ তম স্থান পেয়েছে ৷ যা ২০১৯ এ ১৫০ এবং২০২০তে ১৫১ ছিল ৷ উত্তর কোরিয়া , ইরিত্রিয়া , ইরান মিয়ানমার , চীনের চেয়ে ভালো হলেও আমরা ভারতীয়রাও ভাল অবস্থানে নেই ৷ভারত ১৪২ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১৪৫ , নেপাল ১০৬ আর ভূটান ৬৫তম স্থানে ৷ ২০১৮তে ভারত ছিল ১৩৮ নম্বরে ৷ সাংবাদিকদের অপমান করে কেউ কেউ বলছে “প্রস্টিটিউট “! ক্ষমতাকে সত্যি কথা শোনাতে গিয়ে এমনটা হচ্ছে ৷ শাসকরা প্রায় সব দেশে সমালোচনা ও গণবির্তক সহ্য করে না ৷ কোন কোন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ক্ষমতালোলুপ বলে অনেক সময় সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ করে না ৷ পৃথিবী জুড়ে গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরা তাই বাড়ছে বৈ কমছে না ৷
ডিজিটাল দুনিয়ার তাৎক্ষণিকতা জানান দিলেও
সভ্যতার বিকাশে নিরপেক্ষ , বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভীক
প্রচার মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার দাবী সর্বস্তরে উঠছে কই ! দেশ ও দশের প্রয়োজনে অনেকেই
জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন ৷ কিন্তু , তাঁরা কি সঠিক দাম পাচ্ছেন !
ক্ষমতাসীনদের জন্য অকুতোভয়
সাংবাদিকদের পেশার ঝুঁকি শুধু নয় চাকরি ক্ষেত্রে চ্যুতিও হচ্ছে ৷ তাই , ঘূণ ধরা সমাজের সঙ্গে অনেকেই আপোস করতে বাধ্য হচ্ছেন ৷ আবার প্রলোভনের
ফাঁদে পড়ে “হলুদ সাংবাদিকতাও ” বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷
আজকে এ নিয়ে সাংবাদিক বন্ধুদের শুধু নয়
ভাবতে হবে সুশীল সমাজের সবাইকে চাপ দিতে
হবে সরকার ও যেকোন বাধাদানকারিকে ৷ এটাই
হোক আজকের অঙ্গীকার ৷ তবেই আমরা মিষ্টি সকাল দেখবো ৷ সমাজ এগিয়ে যাবে ৷ কলম
হবে তরোয়ালের চেয়ে ধারালো ৷ সেই দিনের অপেক্ষায় আর কত দিন ? আসুন সবাই একজোট হয়ে উন্নত দেশ তথা বিশ্ব এবং উন্নত জীবনযাপনের জন্য এই দিনটি পালন করি ৷ বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবস বা মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে অকুতোভয় সাংবাদিকদের অভিনন্দন।
Be First to Comment