Press "Enter" to skip to content

” বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ – কুম্ভমেলা “!….

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। “কুম্ভ মেলা ” শুধু হিন্দুর ধর্ম , সংস্কৃতি , আধ্যাত্মিকতা ও ঐতিহ্যের মহামিলনক্ষেত্র নয় , সনাতনী বিশ্বাস , ঐক্য , ভক্তি ও ত্যাগের প্রতীক ৷ মানবতার এক মহা সম্মেলন ৷ ইউনেস্কো একে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক প্রতীক ‘ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে ৷ ভারতের চারটি তীর্থস্থান –
প্রয়াগরাজ বা এলাহাবাদ , হরিদ্বার , উজ্জয়িনী এবং নাসিকে ১২ বছর অন্তর পূর্ণ কুম্ভ মেলা হয় ৷ প্রতি ৬ বছর অন্তর হয় অর্ধকুম্ভ এবং ১৪৪- বছর অন্তর হয় এবারের মত “মহাকুম্ভ ” মেলা ৷ প্রয়াগ ও হরিদ্বারে প্রতি ছয় বছর অন্তর অর্ধ কুম্ভ অনুষ্ঠিত হয় ৷ প্রয়াগে হয় – গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমে , হরিদ্বারে -গঙ্গার তীরে , উজ্জয়িনীতে হয় শিপ্রা নদীর তীরে এবং নাসিকে গোদাবরী নদীর তীরে ৷ কুম্ভের সময় নির্দিষ্ট হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে৷ প্রয়াগের ক্ষেত্রে – বৃহস্পতি ও সূর্য মেষ রাশিতে থাকলে ৷ হরিদ্বারে – যখন বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে থাকে ৷ উজ্জয়িনীতে -বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে থাকার সময় এবং নাসিকে -বৃহস্পতি ও সূর্য সিংহ রাশিতে থাকলে কুম্ভ স্নান হয় ৷ মনে করা হয় কুম্ভে স্নান করলে সব পাপ দূর হয় ৷ মহর্ষি দূর্বাসা মুনির অভিশাপে দেবতারা দূর্বল হয়ে পড়লে ভগবান বিষ্ণু ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করার পরামর্শ দেন ৷ অমৃত পাওয়ার জন্য দেবতা ও অসুররা সমুদ্র মন্থন করলে সেই সমুদ্র থেকে অমৃত ভর্তি কলসী উঠে আসে ৷ অমৃত খেলে অমর হওয়া যায় ৷ তাই , দেবাসুর দু পক্ষই অমৃত পেতে উদ্যোগী হলে দেবরাজ ইন্দ্রের ছেলে জয়ন্ত সেই অমৃত কলস নিয়ে পালিয়ে যান ৷ আর তা নিয়ে দেবাসুরে যুদ্ধ লাগলে জয়ন্ত সেই কলস ১২ দিন ধরে প্রয়াগরাজ , হরিদ্বার , উজ্জয়িনী ও নাসিকে সংরক্ষিত রাখেন ৷ চন্দ্র কুম্ভকে ক্ষরণ থেকে , সূর্য কুম্ভকে বিস্ফোরণ থেকে, দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরদের অপহরণ থেকে ও শণি দেবেন্দ্রর ভয় থেকে কুম্ভকে রক্ষা করেন ৷ কুম্ভের অমৃতের কয়েক ফোঁটা ঐ চার স্থানে পড়ে যায়৷ অতএব , এই চার জায়গা পবিত্র তীর্থ রূপে চিহ্নিত হয় ৷ সেখানকার নদীতে কুম্ভ যোগে স্নান করলে পাপ মোচন হয় এবং মোক্ষ লাভ হয় , রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের অধিক পূণ্যলাভ হয় ৷ হাজার বছর ধরে সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে ৷ প্রাচীন পান্ডুলিপিতে একে মাঘ মেলা বলা হয়েছে ৷ ৮ম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য হিন্দুধর্মের বিভিন্ন মঠের সাধু সন্তদের কুম্ভ মেলার সমাবেশে আলোচনা , বিতর্ক ও স্নানের বিধিনিয়ম চালু করেন ৷ বিশেষ যোগে হয় ‘শাহি বা অমৃত স্নান ‘৷ দেবতাদের একদিন মানে পৃথিবীর মানুষের এক বছর ৷ এজন্য ১২ বছর অন্তর এই চারটি জায়গায় কুম্ভমেলা হয় ৷ হিন্দু বিশ্বাস এই সময় মহাজাগতিক শক্তির দ্বারা নদী প্রভাবিত হয় ৷ জড়ো হন নাগা সন্ন্যাসী সহ হিন্দুদের সমস্ত মত ও পথের সাধু ও সন্ন্যাসী ৷ সারা বিশ্ব থেকে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী কোটি কোটি পূর্ণ্যার্থীরা স্নান করেন ৷ পূণ্যাত্মা সাধু , সন্তদের দর্শন লাভ করা যায় ৷ ধর্মীয় আলোচনা , শোভাযাত্রা , যোগ সাধনা , ভক্তিমূলক গান , শাস্ত্র পাঠ , কথকতা প্রত্যক্ষ করেন ৷ ভারতবর্ষের বিবিধের মাঝে মিলনের এই ঐতিহ্য দেখতে দেশ বিদেশের অসংখ্য দর্শনার্থীরাও এসে দেখে অবাক হন ৷ এবারে প্রয়াগ মহাকুম্ভ মেলা শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারী থেকে ৷ চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৪৫ দিন ৷ এর মধ্যে অমৃত বা শাহি স্নানে যোগ হলো পৌষ পূর্ণিমা , মকর সংক্রান্তি , মৌনী অমাবস্যা , বসন্ত পঞ্চমী , মাঘী পূর্ণিমা ও মহা শিবরাত্রিতে ৷ ২০২৫ এর এই কুম্ভে আনুমানিক ৪০ থেকে ৪৫
কোটি মানুষ আত্মার পরিশুদ্ধি ও মুক্তির জন্য কুম্ভ স্নান করবেন বলে আশা করা হচ্ছে ৷ এবারে কোটি কোটি মানুষের ভীড়ে কিছু তাঁবুতে আগুন লেগেছিল ও মৌনী অমাবস্যা যোগে স্নানের সময় পদপিষ্ট হয়ে অন্তত ৩০ জন তীর্থযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে ৷ পদদলনে ভীড়ে মৃত্যু পৃথিবীর নানা স্থানে বারবার ঘটেছে ৷ ১৯৯০ সালে সৌদী আরবে হজ্জের সময় ১৪০০ জন পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন ৷ ২০০৬ সালেও সেখানে একই ঘটনায় ৩৬০ জনের মৃত্যু হয় ৷ ২০১৫ সালে মক্কার হজ্জে এই সংখ্যা ২৩০০ জন ৷ এই প্রয়াগের কুম্ভেই ১৯৫৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী ৮০০ জনের বেশী মানুষের মৃত্যু হয় ৷ ২০১৩ সালেও ঐ মেলায় ৩৬ জন মারা যান ৷ ১৯৮৬ সালে হরিদ্বারের কুম্ভে রেল ব্রীজ ভেঙে দুশো পূর্ণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছিল ৷ ২০০৩ সালে মহারাষ্ট্রের নাসিকের গোদাবরী তীরের কুম্ভ মেলায় সরকারী ভাবে ৩৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল ৷ কোটি কোটি মানুষের স্নান নিয়ে যাতে বিশৃঙ্খলা না ঘটে প্রশাসনের আরো সতর্ক হওয়া উচিত ৷ ভি আইপিদের বিশেষ সময়ে স্নানে আসা বন্ধ হওয়া দরকার ৷ বহু বছর বাদে পুনরায় মুক্তবেণীর ত্রিবেণী (হুগলী জেলায় ) ও গঙ্গার অপর পাড়ে কল্যাণীতে বঙ্গীয় কুম্ভ মেলা হচ্ছে ৷ তামিল কুম্ভ মেলা বলা হয় কুম্বকোনামে কাবেরী নদীর তীরে ৷ মহামাহাম ট্যাঙ্কের এই মেলায় লক্ষ লক্ষ দক্ষিণ ভারতীয় সহ সারা ভারতের অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবল্মবী পূণ্যস্নান করেন ৷ কুরুক্ষেত্র , সোনেপত এবং নেপালের পানাউটিতে হয় অনেকটা কুম্ভের মত মকর বা মাঘ মেলা ৷ সংস্কৃত ‘কুম্ভ’ অর্থ কলস বা কলসী বা ঘট ৷ খগ্বেদে(১০/৮৯/৭) , যজুর্বেদে( ১৯/১৬) , সামবেদে(৬/৩) এবং অথর্ববেদে (১৯/৫৩/৩) ও বিভিন্ন বৈদিক এবং বৈদিকোত্তর সাহিত্যে কুম্ভ কথাটির উল্লেখ আছে ৷ মহাভারত বলেছে অতীতের ভুল ও অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয় কুম্ভ স্নানে ৷ তবে , ভৌগোলিক এই তীর্থকে হৃদয়ের বা মানস তীর্থের সাথে মিলিত হতে হবে ৷ ৭-ম শতকের চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াগে অনুষ্ঠিত কুম্ভ মেলার বিবরণ আছে ৷ স্নান পর্বে ও প্রয়াগ মাহাত্ম্যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে ৷ জ্যোতিষশাস্ত্রে যা কুম্ভ রাশির চিহ্ন ৷ ‘মেলা’ শব্দের সংস্কৃত অর্থ মিলিত হওয়া , একত্রিত হওয়া, সমাবেশ বা যোগদান করা ৷ কুম্ভমেলা মানে জল বা অমরত্বের কারণীভূত অমৃতর পাশে সমাবেশ বা একতা ৷ কুম্ভে প্রথম নাগা সাধুরা স্নান করেন ৷ অনেক কৃচ্ছসাধন করে নাগা সাধু হতে হয় ৷ তাঁরা ধর্ম রক্ষার সৈনিক ৷ এজন্য জীবন দানে সদা প্রস্তুত ৷ অন্য সাধুদের পর গৃহস্থ ভক্তরা স্নান করেন ৷ সাধারণভাবে পাঁচটি ডুব দিয়ে স্নান করা উচিত ৷ স্নানের পবিত্র জল হাতে নিয়ে মাথার উপর তুলে সূর্যাঘ্য দিতে হয় ৷ দম্পতিদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম অবশ্য পালনীয় ৷অবিবাহিতরা এর কম বেশী ডুব দিতে পারেন ৷ প্রয়াগে স্নানের পর হনুমান ও বাসুকী নাগ মন্দির দর্শণ এবং গরিব ও প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করা উচিত ৷ এবারের মত মহাকুম্ভ যোগ আমরা কয়েক পুরুষ দেখতে পাবো না ৷ ১৪৪ বছর লাগবে এমন যোগ আসতে ৷ জয়তু কুম্ভ ৷

More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.