Press "Enter" to skip to content

বিশ্বজয়ী ‘দুয়ার ভাঙা’ মেয়েদের দেখে অনেক অভিভাবকই সাহস করে নিজের মেয়েটিকে নিয়ে এ বার ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে ভিড় জমাবেন….।

Spread the love

চন্দন রুদ্র : কলকাতা, ৫ নভেম্বর, ২০২৫। “সৌরভ-সচিনদের জনপ্রিয়তাকে হিংসে করেন?” সেদিন আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রশ্নটি সরাসরি রেখেছিলাম ঝুলন গোস্বামীর কাছে। ১৭-১৮ বছর আগে দেশের মেয়েদের ক্রিকেটের ছবিটা আজকের মতো এত উজ্জ্বল ছিল না মোটেই। তখন পুরুষ ক্রিকেটারদের তুলনায় মেয়েদের ক্রিকেট সব দিক থেকেই ছিল পিছিয়ে।

উসকে দেওয়া প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে ভেবেছিলাম ঝুলন বুঝি মেয়েদের ক্রিকেটের এতদিনের নানা বঞ্চনা আর উপেক্ষার কথাই তুলে ধরবেন। কিন্তু না, আজকের মতো পরিণত না হয়েও আমাকে অবাক করে সেদিন ঝুলনের উত্তর ছিল,”হিংসে করতে যাব কেন? ওঁরা ক্রিকেটের এক একজন আইকন। ভাল খেলছেন বলেই তো ওঁদের এত প্রচার, এত জনপ্রিয়তা। আমরা মেয়ে ক্রিকেটাররা সেই জায়গায় পৌঁছতে পারলে, আমাদেরও জনপ্রিয়তা বাড়বে। আর্থিক সাফল্য আসবে।”

দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফাইনালে ৫২ রানে হারিয়ে প্রথম বার ভারতের মেয়েদের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জয়ের পর সারা দেশজুড়ে যে উন্মাদনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাতে অনুমান করা যায় সেদিন বছর পঁচিশের মেয়ে ঝুলনের বলা কথাগুলিই যেন আজ অতি সত্যি হয়ে সামনে চলে এসেছে।

প্রথম বার ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জিতে হরমনপ্রীত কৌর,শেফালি ভার্মা,রিচা ঘোষ,দীপ্তি শর্মা,স্মৃতি মন্ধানাদের নাম ক্রিকেট বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে উল্কার গতিতে। রোহিত শর্মা,বিরাট কোহলি,শুভমন গিল,যশপ্রীত বুমরাদের মতোই তাঁরাও এখন এক একজন বিশ্ব ক্রিকেটের মহাতারকা। সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশ্বজয়ী মেয়েদের ছবি।

হরমনপ্রীত, রিচাদের সাফল্য মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন রাতের কথা। দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪৩ রানে হারিয়ে কপিল দেবের নেতৃত্বে দেশের ক্রিকেটাররা প্রমাণ করেছিল ক্রিকেটে ভারতও বিশ্বজয়ী হতে পারে।

কপিল দেবের ভারত লর্ডসে শক্তিশালী ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের পর শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়ান ক্রিকেটেই উদ্দীপনার ঢেউ আছরে পড়েছিল। ভারতের পরে ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান, ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা।

সাত বারের বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া, চার বারের ইংল্যান্ড এবং এক বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডের পাশে মহিলা ক্রিকেটের বিশ্বজয়ীদের তালিকায় এ বার উঠে পড়ল ভারতের মেয়েদের নাম। কপিল বাহিনীর মতো হরমনপ্রীত বাহিনীও অবশেষে প্রমাণ করল ‘আমরাও পারি’।

দু’বার ফাইনালে উঠে ভারতের মেয়েদের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছিল। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের পর ২০১৭ সালে মাত্র ৯ রানে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ হারিয়েছিলের ঝুলন, হরমনপ্রীতরা। সেই ভারত এখন মেয়েদের ক্রিকেটে বিশ্বজয়ী।

একটা সময় ভারতের মহিলা ক্রিকেট ওই শখের খেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরিকাঠামোর অভাবে মেয়েদের ভাল অনুশীলনের সুযোগ ছিল না। ছিল না ভাল স্পনসরশিপের ব্যবস্থাও। নানা বৈষম্যের মধ্যেই চলত দেশের মেয়েদের ক্রিকেট।

এই বাংলার মেয়েদের ক্রিকেটও ছিল বেহাল দশায়। মনে পড়ছে,কলকাতায় হিরো কাপের সময় ইডেন গার্ডেন্সের একটা টিকিটের জন্য বাংলার প্রাক্তন মহিলা ক্রিকেটারদের হাপিত্যেশের কথা। ওই সময় প্রাক্তনদের প্রতি এই বঞ্চনা নিয়ে সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদনও লিখেছিলাম। আজ সেই ইডেনেই ঝুলন গোস্বামীর নামে ‘ক্রিকেট স্ট্যান্ড’ তৈরি হয়েছে। ইডেনের বাইরেও পুরুষ ক্রিকেট তারকাদের সঙ্গে ঝুলনের ছবি।

গ্রামের মেয়ে ঝুলন গোস্বামীর আজকের ঝুলন হয়ে ওঠার পেছনে কম লড়াই ছিল না! ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের আওতায় আসার পর থেকেই দেশের মেয়েদের ক্রিকেটের ছবিটা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। বিসিসিআই-এর নানা উদ্যোগের ফলেই আজ ভারতের মেয়েরা পুরুষ ক্রিকেটারদের মতোই ক্রিকেট খেলাটাকে কেরিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারছেন। উঠে আসছেন অনেক নতুন নতুন ক্রিকেটার। এ বার সেই প্রবণতা আরও বাড়বে।

বিশ্বজয়ী ‘দুয়ার ভাঙা’ মেয়েদের দেখে অনেক অভিভাবকই সাহস করে নিজের মেয়েটিকে নিয়ে এ বার ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে ভিড় জমাবেন। পুরুষ ক্রিকেটের মতো আরও বেশি টেস্ট, আরও বেশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেলে দেশের মেয়েরা ক্রিকেটে আরও অনেক সাফল্যই নিয়ে আসবেন।

দেশের মাটিতে বিশ্বকাপে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়েদের হারিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের পর সারা দেশের সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে হরমনপ্রীতদের সাফল্যের বিজয় কাহিনি। কপিল বাহিনীর বিশ্বজয়ের মতোই হরমনপ্রীতদের বিশ্বজয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন আর এক মাইলফলক তৈরি হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের জয়ের উৎসবে ভেসেছে গোটা দেশ।

মেয়েরা নাকি দেশে নিরাপদ নন! সমাজে একলা হয়ে পড়া মেয়েরা নাকি আতঙ্ক নিয়ে বাঁচেন। অথচ সেই মেয়েদের জয় দেখতেই ক্রিকেট মাঠ এবং বাড়িতে টিভি সেটের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছেন দেশের অসংখ্য মানুষ। আসুন, মেয়েদের আর ‘মেয়ে’ নয়, এ বার থেকে আমরা সবাই মেয়েদের একজন ‘মানুষ’ হিসেবে দেখতে শুরু করি! হরমনপ্রীত,রিচাদের সাফল্য নিয়ে দু’চার কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে ঘরেবাইরে লড়াই করে দেশকে ‘সুনাম’ এনে দেওয়া এমন আরও অজস্র লড়াকু মেয়ের গল্প।

ভারতের পুরুষ ক্রিকেটারদের মতোই ভারতের মহিলা ক্রিকেটাররাও এখন বিশ্বসেরা। ২৫ জুন,১৯৮৩ সালের মতোই ক্রিকেটের রেকর্ড বুকে এ বার স্মরণীয় হয়ে গেল ২ নভেম্বর,২০২৫। বিশ্ব ক্রিকেটে নজির গড়া এ এক দুরন্ত জয় বৈকি!

More from InternationalMore posts in International »
More from SportMore posts in Sport »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.