স্মরণঃ র ণ দা প্র সা দ সা হা
বাবলু ভট্টাচার্য : আমাদের সমাজে বীরের সংখ্যা অতি অল্প, যারা তা দেখাতে পারেন তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জাগে আপনা থেকেই। তেমনই একজন শ্রদ্ধেয় বীরের নাম রণদা প্রসাদ সাহা।
১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা জেলার উপকণ্ঠ সাভারের কাছুর গ্রামে মামার বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ সাহা পোদ্দার এবং মা কুমুদিনী দেবী। তার পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইল জেলার মীর্জাপুরে।
চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি মীর্জাপুর বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তার পিতা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। তার বয়স যখন সাত বছর, তখন তার মাতা সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। বিমাতার আশ্রয়ে বহু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ও অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে রণদা’র শৈশবকাল অতিবাহিত হয়। তাই মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে যান তিনি।
অচেনা-অজানা পরিবেশে পেটের তাগিদে জীবন বাঁচাতে কুলিগিরি, রিকশা চালানো, ফেরি করা, খবরের কাগজ বিক্রির মতো বিচিত্র কাজ করেছেন রণদা। কলকাতায় তখন সারাবাংলা থেকে কাজের সন্ধানে ছুটে আসা ভুখা মানুষের ভিড়। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে এরইমধ্যে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেন তিনি।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ভারত থেকেও অসংখ্য তরুণ যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নাম লেখায়। বাংলার সেই কিশোর যোগ দেয় বাঙালিদের প্রথম সামরিক সংগঠন বা ইউনিট ‘বেঙ্গল এ্যাম্বুলেন্স কোর’-এ।
যুদ্ধ শেষে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে রেলওয়ে বিভাগের টিকিট কালেক্টরের চাকরি নেন। ১৯৩২ সালে এই চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। নিজের সঞ্চয় করা ও অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে শুরু করেন লবণ ও কয়লার ব্যবসা। বছর চারেকের মধ্যেই ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন তিনি। পরবর্তীতে কয়লার ব্যবসায় লাভ বেশি হওয়ায় লবণের ব্যবসা বাদ দিয়ে কয়লার ব্যবসায় মনোযোগ দেন।
১৯৩৯ সালে জমিদার নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, বিচারপতি জে. এন. মজুমদার ও নলিনী রঞ্জন সরকারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ নামে একটি নৌ-পরিবহণ কোম্পানি। কিন্তু, অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্য শরিকদের কাছ থেকে সব অংশ কিনে নিয়ে তিনি কোম্পানির একক মালিকানা লাভ করেন। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া।
কোম্পানির লঞ্চগুলির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জে একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ করেন। এ অঞ্চলে এটিই প্রথম ডকইয়ার্ড। সেখানে বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের লঞ্চ ছাড়াও অন্যান্য কোম্পানির এবং ব্যক্তিগত লঞ্চও মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো।
১৯৪০ সালে রণদা নারায়ণগঞ্জের জর্জ অ্যান্ডারসনের যাবতীয় পাট ব্যবসা কিনে নেন। পাট মজুদের জন্য তিনি পাটকল সংলগ্ন বেশ কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করেন।
এভাবে যে কিশোর তার মাকে হারিয়েছে চিকিৎসার অর্থাভাবে, বড় হয়েছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে তিনিই পরে হয়ে উঠেন দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একজন।
দেশ বিভাগের আগেই রণদা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি চাকরি শুরু করেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে অসুস্থ ও আহতদের সেবাদানের মাধ্যমে। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার পরও তিনি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবা প্রদান অব্যাহত রাখেন।
শৈশব থেকে মানবকল্যাণের যে স্বপ্ন নিজের মনে লালন করেছিলেন তার বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৩৮ সালে মাতামহীর নামে শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারি ও মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আড়াইশো লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন তিনি। রণদা প্রসাদের আহ্বানে ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড আর জি কেসি কলকাতা থেকে নদীপথে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসে কুমুদিনী হাসপাতাল উদ্বোধন করেন।
১৯৪৩ সালে কুমুদিনী হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৩ সালে হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা চালু হয়। বাংলাদেশে এখানেই প্রথম ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয়।
১৯৪৭ সালে রণদা তার সব ব্যবসা, কল-কারখানা, সম্পত্তি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার জন্য ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ গঠন করেন।
মানবতাধর্মী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার রণদাপ্রসাদ সাহাকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব প্রদান করে। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মানবসেবায় অসামান্য অবদান রাখায় ও তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মে পাকহানাদার বাহিনী রণদা প্রসাদ ও তার ২৬ বছর বয়সী ছেলে ভবানীপ্রসাদ সাহা (রবি)-কে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাদের আর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
Be First to Comment