জন্মদিনে স্মরণঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাবলু ভট্টাচার্য : প্রকৃতির সৌন্দর্যের অনুভবী সাহিত্যিক অথবা শুধু সহজ মানুষের নির্বিকার রূপকার তিনি নন; তাঁর লেখার ভাঁজে- ভাঁজে আবিষ্কার করা যায় অভিজ্ঞতার অনেক বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি, জীবনের অনেক রহস্য ও জটিলতা।
নানা ধরনের মানুষ, নানা জীবিকার মানুষ, নানা স্বভাবের মানুষ বিভূতিভূষণের সাহিত্যে যেভাবে জড়িয়ে আছে, তার তুলনা কোথাও নেই। বাঙালি জীবনের ও সমাজের খুঁটিনাটি, যাকে বলা যায় বিষয়জ্ঞান বা বস্তুজ্ঞান— অভিজ্ঞতার নির্বিশেষ নয়, বিশেষ চেহারা— তার ব্যাপক পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লেখায়।
বিভূতিভূষণ কর্মসূত্রে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের ঘনিষ্ঠ সহচর হয়েছিলেন। লব্ধ অভিজ্ঞতাকে শিল্পীর নিপুণ তুলিকায় রূপায়িত করেছেন তাঁর উপন্যাসগুলোতে। তাঁর ছাপ্পান্ন বছর জীবনে রচিত সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংখ্যা ১৪টি; অসম্পূর্ণ উপন্যাসও আছে একটি। এছাড়া গল্প, অনুবাদ, ভ্রমণ কাহিনিসহ সাহিত্যের ইত্যাদি শাখায় তাঁর লেখার সংখ্যা অসংখ্য।
বিভূতিভূষণের পৈতৃক বাড়ি উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাকপুর গ্রামে। তার বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত। পাণ্ডিত্য ও কথকতার জন্য তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। মায়ের নাম মৃণালিনী দেবী। এ দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ সবার বড়।
বাবার কাছে বিভূতিভূষণের পড়ালেখার হাতেখড়ি। এরপর গ্রামের কয়েকটি পাঠশালায় পড়ার পর বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মেধাবী বিভূতিভূষণ সেখানে অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ার সুযোগ পান। ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা মারা যান।
১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স এবং ১৯১৬ সালে কলকাতার রিপন কলেজ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। একই কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় ডিস্টিংশনসহ পাস করেন। এরপর এমএ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হন। কিন্তু মাঝপথে হুগলী জেলার জাঙ্গীপাড়ায় দ্বারকানাথ হাইস্কুলে চাকরি নেন। এ সময় স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেক দিন সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করেন।
১৯২১ সালে (১৩২৮ বঙ্গাব্দ) প্রবাসী পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় ‘উপেক্ষিতা’ নামক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত। ভাগলপুরে কাজ করার সময় ১৯২৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ রচনা শুরু করেন। লেখা শেষ হয় ১৯২৮ সালে। এটি তাঁর প্রথম ও শ্রেষ্ঠ রচনা। এর মাধ্যমেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর উপন্যাসটির পরের অংশ ‘অপরাজিত’ রচনা করেন। উভয় উপন্যাসেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে।
সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের কাহিনিকে চলচ্চিত্রে রূপদানের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা করেন। চলচ্চিত্রটি দেশি-বিদেশি প্রচুর পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করে। এরপর ‘অপরাজিত’ অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’। চলচ্চিত্র তিনটি ‘অপু ট্রিলজি’ নামে সারাবিশ্বে পরিচিত।
‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস নিয়েও সত্যজিৎ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিও বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। সম্প্রতি শিশুতোষ উপন্যাস ‘চাঁদের পাহাড়’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি ভারতীয় বিভিন্ন ভাষা এবং ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যেঃ ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ (১ম ও ২য় খণ্ড), ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’, ‘আরণ্যক’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘বিপিনের সংসার’, ‘দুই বাড়ি’, ‘অনুবর্তন’, ‘দেবযান’, ‘কেদার রাজা’, ‘অথৈ জল’, ‘ইচ্ছামতী’, ‘অশনি সংকেত’ এবং ‘দম্পতি’।
গল্প-সংকলনঃ ‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরীফুল’, ‘যাত্রাবাদল’, ‘জন্ম ও মৃত্যু’, ‘কিন্নর দল’, ‘বেণীগির ফুলবাড়ী’, ‘নবাগত’, ‘তালনবমী’, ‘উপলখণ্ড’, ‘বিধুমাস্টার’, ‘ক্ষণভঙ্গুর’, ‘অসাধারণ’, ‘মুখোশ ও মুখশ্রী’, ‘আচার্য কৃপালিনী কলোনি’ (পরে ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’), ‘জ্যোতিরিঙ্গন’, ‘কুশল-পাহাড়ী’, ‘রূপ হলুদ’, ‘অনুসন্ধান’, ‘ছায়াছবি’ এবং ‘সুলোচনা’।
কিশোরপাঠ্যঃ ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘আইভ্যান হো’, ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’, ‘মিসমিদের কবচ’, ‘হীরা মাণিক জ্বলে’ এবং ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ (ভুবনমোহন রায়ের সঙ্গে)।
ভ্রমণকাহিনি ও দিনলিপিঃ ‘অভিযাত্রিক’, ‘স্মৃতির রেখা’, ‘তৃণাঙ্কুর’, ‘ঊর্মিমুখর’, ‘বনে পাহাড়ে’, ‘উৎকর্ণ’ এবং ‘হে অরণ্য কথা কও’।
অন্যান্যঃ ‘বিচিত্র জগৎ’, ‘টমাস বাটার আত্মজীবনী’, ‘আমার লেখা’, প্রবন্ধাবলী, পত্রাবলী এবং দিনের পরে দিন।
‘ইছামতী’ উপন্যাসের জন্য তিনি মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫১) লাভ করেন। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার (লেখকের জন্মস্থান) পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম লেখকের সম্মানার্থে রাখা হয়েছে ‘বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের আজকের দিনে (১২ সেপ্টেম্বর) পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁ মহকুমার ঘোষপাড়া-সুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment