Press "Enter" to skip to content

বিধাতা পুরুষের চিত্রনাট্যে সলিল চৌধুরি নামক এক ভবিষ্যৎ কম্পোজারের জীবনের প্রথম অংকের সূচনা হল। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার সুরকার এবং কম্পোজার…….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ সলিল চৌধুরী

বাবলু ভট্টাচার্য : আসামের চা বাগানের নিস্তরঙ্গ পরিবেশে বেড়ে উঠছে একটি বালক। বাবা চা বাগানের ডাক্তার। চারিপাশে গাছ-গাছালির সবুজ ছায়া। ঝিম ধরা প্রকৃতির মাঝে হঠাৎ হঠাৎ শোনা যায় অদ্ভুত সব পাখির ডাক। স্থানীয় আদিবাসীদের গান আর কে যেন বাঁশি বাজায় অনেক দুর থেকে।

তার বাবার পূর্বতন ডাক্তার ছিলেন এক আইরিশ। এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি জলের দামে বিক্রি করে দিলেন তার পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের প্রচুর রেকর্ড আর একটি পিয়ানো। বালকটির পিতা কিনে নিলেন। মোৎজার্ট, চোপিন, চাইকোভস্কি, বিথোফেন আরও অনেকের রেকর্ড।

বালকটির বিলম্বিত লয় জীবনে এই রেকর্ডগুলি নিয়ে এলো যেন কোনো স্বর্গলোকের চাবিকাঠি। শুনতে শুনতে তার মনে হতে লাগলো সাতটি সুরের তৈরি এক অদ্ভুত জগৎ তাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে।

বালকটির পিতার ছিল অভিনয়ের শখ। চা বাগানের কুলিদের নিয়ে তিনি করতেন নানা রকমের নাটক, যাত্রাপালা। সেখানে থাকতো দেশজ গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ইত্যাদি মাটির গন্ধমাখা সহজ সরল গান। দুরকমের গানই তাকে আকর্ষণ করলো। এই দুই বিপরীত স্রোতের গান তার চেতনার মধ্যে তোলপাড় লাগিয়ে দিল। বিধাতা পুরুষের চিত্রনাট্যে সলিল চৌধুরি নামক এক ভবিষ্যৎ কম্পোজারের জীবনের প্রথম অংকের সূচনা হল এখানেই।

ইতিমধ্যে তার স্কুলের পড়া শেষ হল। কলেজে ভর্তি হতে চলে এলেন কলকাতা।

১৯৪৪ সাল। সে এক উত্তাল সময়। একদিকে স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলান তখন তুঙ্গে। অন্যদিকে কমিউনিস্টপার্টি সংগঠিত হচ্ছে প্রতিবাদের নতুন ভাষা নিয়ে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা IPTA তখন সারা দেশ জুড়ে এক অসাধারণ উন্মাদনা সৃষ্টি করলো সমস্ত শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে। সলিল যোগ দিলেন IPTA তে।

তিনি লিখতে শুরু করলেন মানুষকে জাগরিত করার গান। নিজেই সুর করলেন সে সব গানে। শ্রমিক কৃষক ও সাধারণ মানুষের সভায় সে সব গান গাওয়া হতে থাকলো। ১৯৪৫ সালে রংপুরে ছাত্র সম্মেলনে প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া হল তার গণসংগীত— ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’।

সে গান মানুষের বুকের ভিতরে গিয়ে ধাক্কা দিল। ১৯৪৬ সালে সারা দেশ জুড়ে পালিত হল রেল ও ডাক ধর্মঘট। অক্টোরলনি মনুমেন্টের পাদদেশে এক বিশাল সমাবেশে গাওয়া হল ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে’— এখানে সলিল তার বামপন্থী চেতনার সঙ্গে মেলালেন তার পাশ্চাত্য সংগীতের জ্ঞান। ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’— একই পর্দায় গাওয়া হচ্ছে কিন্তু বদলে যাচ্ছে কর্ড। যেন ঢেউ ক্রমশ উত্তাল হতে হতে কারা প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলছে।

ইতিমধ্যে ভারত স্বাধীন হয়েছে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়েছে। এরকম একটা সময়ে জর্জ (দেবব্রত) বিশ্বাসের বাড়িতে বিশ বছরের যুবক সলিলের সঙ্গে দেখা হল এক উদীয়মান গায়কের, তিনি হেমন্ত মুখার্জি। পরিচয় না থাকলেও দু’জনে দু’জনের গুণগ্রাহী।

দু’জনের আলাপে তৈরি হল একটি ইতিহাসের পটভূমিকা। সলিল অনুরোধ করলেন হেমন্তকে তার সুরে গান গাইবার জন্য। গানটির বিষয় চিরাচরিত প্রেম নয়, এক গাঁয়ের বধূর আশা ও স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি। ১৯৪৯ সালে এই গানটি ইতিহাস সৃষ্টি করল।

১৯৪৯ এ বাংলা সিনেমায় সুর করার সুযোগ পেলেন সলিল। তিনি পালন করতে লাগলেন একাধারে গীতিকার সুরকার এবং কম্পোজারের তিনটি ভূমিকা। বেশ কয়েকটি বাঙলা ছবির সুর দেওয়ার পর ডাক পেলেন মুম্বাইয়ের বিমল রায়ের কাছ থেকে। সলিল চৌধুরিরই একটি গল্প নিয়ে ছবি। সিনেমার নাম ‘দো বিঘা জমিন।’ সলিলের কম্পোজিশনে গানগুলি খুব জনপ্রিয় হল। সলিল রয়ে গেলেন মুম্বাইতে।

একদিকে বিভিন্ন লোক সংগীত, পাঞ্জাবী ভাঙ্গড়া, আসামের বিহু গানের সুর ব্যবহার করে স্রোতাদের মন জয় করে নিলেন সলিল। তেমনি অন্যদিকে রোমানিয়ান ও রাশিয়ান ফোক গান ভেঙ্গে তৈরি করলেন ‘ঘড়ি ঘড়ি মোরা দিল ধড়কে’ আর ‘শ্যামল বরনী ওগো কন্যা’ গানে।

সলিল চৌধুরি শুধু যে অসাধারণ কম্পোজার ছিলেন তাই নয়, তার লেখনীও ছিল সমপরিনাম শক্তিশালী। প্রতিবাদের গান, রোমান্টিক গান, শিশুদের জন্যে গান, ব্যাঙ্গের গান— যখন যা লিখেছেন তাতেই তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। শুধু তাই নয় অনেক গানেই চেষ্টা করেছেন সমাজ সচেতনার ছাপ রাখতে।

সলিল চৌধুরী ১৯২২ সালের আজকের দিনে (১৯ নভেম্বর) পশ্চিমবঙ্গ চিংড়ীপোতায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.