স্মরণঃ ‘কান্তকবি’ রজনীকান্ত সেন
বাবলু ভট্টাচার্য ; বাংলা ভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সঙ্গীত রচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের বলা হয় ‘পঞ্চকবি’। রজনীকান্ত সেন সেই ‘পঞ্চকবি’দেরই একজন। সাহিত্য সাধনায়, আরাধনামূলক অসাধারণ সঙ্গীত সৃষ্টি এবং দেশাত্মবোধক আন্দোলন সংগ্রামে মুখর এই কবির আলোচনা, প্রচারণা নিতান্তই অপ্রতুল।
রজনীকান্তের অসংখ্য গান ও কবিতাই রয়ে গেছে অশ্রুত কিংবা স্বল্পশ্রুত। অথচ রজনীকান্তের গানে বাণী ও ছন্দের যে মেলবন্ধন, সুরের যে অপূর্ব লয়, সর্বোপরি ভাবের যে গভীরতা, তা এককথায় অতুলনীয়।
রজনীকান্ত সেন ২৬ জুলাই, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচিতে জন্মগ্রহণ করেন।
তার মা মনমোহিনী দেবী সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তিনি বৈষ্ণব ব্রজবুলি ভাষায় রচিত প্রায় ৪০০টি বৈষ্ণব পদাবলির একটি সংকলন প্রকাশ করেন ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামে।
ছেলেবেলায় বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন রজনী। সারাদিনের দুরন্তপনা শেষে পড়াশুনার ফুরসতই মিলত না তাঁর। অসম্ভব মেধার কারণে বরাবরই পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন রজনীকান্ত।
ছোটবেলায় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে (তৎকালীন বোয়ালিয়া জেলা স্কুল) ভর্তি হন। কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ, কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ ও বিএল (ব্যাচেলর ইন ল’) পাস করেন।
রজনীকান্তের পিতা আইনজীবী হওয়ায় সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল। কিন্তু সাব-জজ পদে অধিষ্ঠিত হবার অল্প দিনের মাথাতেই অসুস্থতাজনিত কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন গুরুপ্রসাদ সেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারে নেমে আসে দারিদ্র্যের কষাঘাত। বিএল পাশ করে রজনীকান্তও পিতার মতো আইন ব্যবসায় নামেন।
রজনীকান্তের মা-বাবা দুজনই ছিলেন সঙ্গীতে যথেষ্ট দক্ষ। মা-বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো বা ছেলেবেলা থেকেই গান-পাগল হয়ে ওঠেন তিনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘কালীসঙ্গীত’ রচনা করে সংগীত সত্ত্বার পরিচয় দেন।
গান রচনায় অস্বাভাবিক দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিলেন তিনি। কলেজের কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হলে পরে রজনীকান্তের ডাক পড়ত। রজনীকান্ত অনুষ্ঠানস্থলে এসে অনুষ্ঠান চলাকালীনই গান রচনা ও তাতে সুর সংযোজন করে তা গেয়ে আসর জমাতেন। তাঁর বিখ্যাত সব গানের বেশির ভাগই খুবই অল্প সময়ের মধ্যে রচিত।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলনে বিলাতী সব পণ্য বয়কট করে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার প্রতি যে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, সে আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের মতো রজনীকান্তও সমর্থন দেন। রজনীকান্ত রচনা করেন-
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।।”
তাঁর এই গানটি গণ-আন্দোলনে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জোয়ার সৃষ্ট করে। এর মাধ্যমেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন এবং ‘কান্তকবি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
রজনীকান্ত সঙ্গীতের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ঈশ্বর-ভক্তিমূলক গানগুলোর জন্যই। জীবনের সমস্ত আনন্দগুলোতে তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করেছেন। গভীর সংকটে যখন তিনি নিপতিত হয়েছেন, একে ঈশ্বরদত্ত আশীষ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। তাই, তাঁর রচিত ভক্তিমূলক নানা গান প্রার্থনারূপে উপাসনালয়গুলোতে আজও গীত হয়।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেশাত্নবোধক গান রচনা এবং অসাধারণ সব প্রার্থনাসঙ্গীত রচনা করে আর জলসায় জলসায় গান গেয়ে যখন রজনীকান্ত পরিচতি পেতে লাগলেন, তখনই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর কণ্ঠনালীতে প্রদাহ দেখা দেয়। পরে চিকিৎসকেরা তাঁর কণ্ঠনালীতে ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসার সনাক্ত করেন।
রজনীকান্ত সেন ১৯১০ সালের আজকের দিনে (১৩ সেপ্টে) কলকাতা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment