ড. বিবেকানন্দ চক্রবর্তী, রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও শিক্ষারত্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। কলকাতা, ৩১ অক্টোবর ২০২২। জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ- জগৎ+ধাত্রী, জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)। ব্যাপ্ত অর্থে ‘দুর্গা’, ‘কালী’ সহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও ‘জগদ্ধাত্রী’। তবে শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পশ্চাতে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন। স্বামী প্রমেয়ানন্দ বলেছেনঃ
“ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী। সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী ও পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য।… ‘ধা’ ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ। ‘ভগবতী’ নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ‘ত্রৈলোক্যজননী’ নামে অভিহিত।… নিয়ত-পরিবর্তনশীল এই জগতের পেছনে রয়েছে তাঁর রক্ষণ ও পোষণের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তির এক অদ্ভুত খেলা। সতত পরিবর্তনশীল জগৎ সেই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত – যিনি নিত্যা, শাশ্বতী ও অপরিবর্তনীয়া। দেবী জগদ্ধাত্রীই সেই ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি।”
হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর।
জগদ্ধাত্রী দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তাঁর হস্তদ্বয়ে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ, করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়।
বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন অষ্টাদশ শতক থেকে। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে অবস্থিত কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মতে এই পূজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) দ্বারা শুরু হয়েছে। তিনি তৎকালীন নবাবের কাছে কোন এক কারণে দুর্গা পূজার সময়ে বন্দি হন এবং পরে দুর্গা পূজার পর ছাড়া পেলে স্বপ্নাদেশে পরের মাসের অর্থাৎ কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে এই পূজার প্রচলন করেন। সময়কাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনুমানিক সূচনাকাল ১৭৬২/৬৩ খৃষ্টাব্দ। এর পর চন্দননগর বা অন্যান্য স্থানে জগদ্ধাত্রীপূজার সূচনা হয়।
অষ্টাদশ শতকে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। জানা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন।
বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬)-এর সহধর্মিণী সারদা দেবী (১৮৫৩-১৯২০)-র জন্মভিটা-র জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। পূজা উপলক্ষ্যে জয়রামবাটীতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে এই পূজার আয়োজন করে রামকৃষ্ণ মিশন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) সারদা দেবীর পিতৃগৃহে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেছিলেন তাঁর জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী।
মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলংকারে ভূষিতা ও নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী। দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু; দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তবস্ত্রপরিহিতা দেবী জগদ্ধাত্রী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেনঃ
“মন করীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।… সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতীকে জব্দ করে রেখেছে।”
স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেনঃ
“যে-কোনো সাধনায় মনকে সংযত করে বশে আনা সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। আমাদের মন মত্ত করী, মন-করীকে বশ করতে পারলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ অবশ্যম্ভাবী।… মত্ত মন-করীকে বশ করে সাধক-হৃদয়ে জগদ্ধাত্রীর প্রতিষ্ঠাই জগদ্ধাত্রী-সাধনার সার্থকতা।”
জগদ্ধাত্রী দেবী-র প্রার্থনা মন্ত্রঃ
‘দয়ারূপে দয়াদৃষ্টে দয়ার্দ্রে দুঃখমোচনি।
সর্বাপত্তারিকে দুর্গে জগদ্ধাত্ৰি নমোঽস্তু তে॥
হে জগদ্ধাত্রী, তুমি দয়াস্বরূপা, কৃপাদৃষ্টিস্বরূপা, করুণাময়ী, দুঃখ-বিনাশিনী, সর্ববিঘ্ননাশিনী; হে দুর্গে, তোমায় নমস্কার।
Be First to Comment