জন্মদিনে স্মরণঃ মো হি নী চৌ ধু রী
‘‘বাংলা গানকে আমি-তুমির প্রেমগাথা থেকে মোহিনী চৌধুরী দেশভাবনা ও গণচেতনার দিকে এনেছিলেন৷ অন্য মাত্রা যোগ করেছিলেন৷ এ জন্যই তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷ কিন্তু আমরা তাকে ভুলে গিয়েছি৷’’
[ সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি ]
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘দিনদুনিয়ার মালিক তোমার’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’-সহ এমন অসংখ্য শ্রুতিমধুর গান এখনো মুখে মুখে ফেরে৷ কিন্তু কালজয়ী এই গীত রচয়িতার নাম আমাদের ক’জনার জানা!
সংগীতের চর্চায় বরাবরই গীত রচয়িতাদের একটু লঘু চোখে দেখা হয়৷ গান হয়ে যায় কণ্ঠশিল্পীর৷ কখনো-সখনো জনপ্রিয় গানের সুরকার কিছুটা কৃতিত্ব পেলেও আড়ালে থেকে যান গীতিকার৷ এই আড়ালে থাকার বেদনা সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন গীতিকার মোহিনী চৌধুরী৷
১৯৪৩ সাল। মোহিনী চৌধুরীর প্রথম রেকর্ড, ‘রাজকুমারী ওলো নয়নপাতা খোল, সোনার টিয়া ডাকছে গাছে ওই বুঝি ভোর হল’, এই গানটি গাইলেন কুসুম গোস্বামী, কমল দাশগুপ্তেরই সুরে। ১৯৪৪ সালে কমল দাশগুপ্তের সুরে মোহিনী চৌধুরীর লেখা গান গাইলেন জগন্ময় মিত্র, ‘ভুলি নাই ভুলি নাই, নয়ন তোমায় হারায়েছি প্রিয়া স্বপনে তোমারে পাই’।
জগন্ময় মিত্র-কমল দাশগুপ্ত জুটি, সঙ্গে মোহিনীবাবুর কথা। দারুণ জনপ্রিয় হল গান। গীতিকারকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘পৃথিবী আমারে চায়,’ ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’, ‘আমি যে দুরন্ত বৈশাখী ঝড়,’ ‘জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে’-র মতো অসংখ্য সোনাঝরা গান লিখে গিয়েছেন প্রতিভাবান এই গীতিকার।
ছাত্রাবস্থায় সপরিবার কলকাতা চলে যান তিনি। ছোটবেলা থেকেই গান লিখতেন, এক দিন বন্ধুর কথা শুনে গানের খাতা পাঠিয়ে দিলেন এইচএমভি অফিসে। কেটে গেল বছর পাঁচ, কোনও ডাকই এল না। তত দিনে জিপিও-তে চাকরি নিয়েছেন তিনি। এক দিন চিঠি বিলি করতে গিয়েছেন এক অভিজাত এলাকায়। সবুজে ঘেরা ছিমছাম একটা বাড়ি থেকে ভেসে এল গানের কলি, গ্রামোফোনে বাজছে— ‘বিদেশি এক রাজার কুমার তোমার পাশে জাগে।’ চমকে উঠলেন মোহিনী। ভীষণ চেনা লাইন!
এর দিন দুয়েক পরে এক সভাতে গিয়ে শুনলেন গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে খুঁজছে। তাঁর গান এইচএমভি থেকে রেকর্ড হয়ে বেরিয়েছে। কিন্তু গানের খাতায় কোনও ঠিকানা লেখা ছিল না বলে তাঁরা গীতিকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর লেখা গান গাইলেন জগন্ময় মিত্র, ‘ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রাণী’। সেই গান হিট হল।
গীতা দত্তের প্রথম বাংলা গানও মোহিনীবাবুর লেখা। ‘তুমি যদি বলো ভালবাসা দিতে জানি না, জানি সে তোমার অভিমান, তাই মানি না সে কথা মানি না।’
শৈলজানন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক। একদিন গানের খাতা নিয়ে মোহিনী সোজা চলে গেলেন শৈলজানন্দনের অফিসে। খাতা উল্টেপাল্টে দেখে শৈলজানন্দন বললেন, ‘‘গানগুলি চমৎকার ভাই। কিন্তু আমি নিতে পারব না এখন।’’ তিনি তখন তাঁর সিনেমার জন্য প্রধানত নজরুলের গানই নিচ্ছেন। মোহিনী চৌধুরী তা শুনে চলে আসছেন, শৈলজানন্দন ডেকে বললেন, ‘‘একটা গান লেখার সুযোগ দিতে পারি। ছবির সিকোয়েন্স অনুযায়ী একটা গান লিখে দিতে হবে।’’ দৃশ্যটা বুঝিয়েও দিলেন।
সেই রাতেই কথা বুনে নিলেন মোহিনী— ‘দিনদুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না।’ গানের কথা শুনে মুগ্ধ শৈলজানন্দ আরও একটা গানের কথা লিখে দেওয়ার ফরমায়েশ করলেন। সেই বছরই অক্টোবরে এইচএমভি থেকে পুজোর গান রিলিজ় হল— কমল দাশগুপ্তের সুরে আর সত্য চৌধুরীর কণ্ঠে, ‘পৃথিবী আমারে চায়।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ভারতের স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগে আগে মোহিনী লিখলেন তাঁর সম্ভবত সব থেকে জনপ্রিয় গান— ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।’
গানটি রেকর্ড হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সুরে, তাঁরই কণ্ঠে। গানটি মুক্তি পেল স্বাধীনতার ঠিক পরেই। এখনও সমান জনপ্রিয় এই গানটি সে যুগে জনমানসে অনন্য প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর কিছু দিন পরেই শৈলজানন্দের ‘মানে না মানা’ ছবির জন্য মোহিনী লিখলেন, ‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়।’ এই গানটিও সাড়া ফেলেছিল।
নীতিন বসু তখন ‘বোম্বে টকিজ’-এর ব্যানারে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ অবলম্বনে ‘সমর’ নামে একটা ছবি বানাচ্ছেন। তার জন্যই চাই একটা ঝুমুর গান। গানের সুরটা এসে গিয়েছে শচীনদেব বর্মণের মাথায়, কিন্তু ঠিক কী চাই, মোহিনীকে সেটা বোঝাতে ইচ্ছেমতো কয়েকটা কথা বসিয়ে নিলেন— ‘টঙ্গালি গো টঙ্গালি, নাকে মুখে চুনকালি।’
মোহিনী লিখলেন, ‘সুন্দরী লো সুন্দরী, দল বেঁধে আয় গান করি।’ গানটি গাইলেন কিশোরকুমারের ভাই অরুণকুমার আর গীতা দত্ত। কোরাসে ছিলেন কিশোরকুমার, রুমা গুহঠাকুরতা। পরে সুরের এই চলনই ‘অনুসন্ধান’ ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন রাহুল। কথার ধাঁচও এক— ‘ফুলকলি রে ফুলকলি।’
তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশভাগের ক্ষত বাঙালির বুকে। শচীনদেব বর্মণ বললেন, গান লিখে দিতে হবে এই অনুভূতি নিয়ে। মোহিনী সারা রাত জেগে রইলেন গান নিয়ে। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে যখন, মোহিনী লিখলেন, ‘শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে বাজে ভাঙা ঢোল/ ও মন, যা ভুলে যা কী হারালি, ভোল রে ব্যথা ভোল।’
পরিচালক শৈলজানন্দনের সঙ্গে একের পর এক কাজ করার সময়েই আইডিয়াটা এসেছিল মোহিনীর মাথায়। ‘রায় চৌধুরি’ ছবিতে সহ-পরিচালকের কাজ শুরু করলেন মোহিনী। সেই সঙ্গে চলতে লাগল গান লেখা। এই সময়েই সরকারি চাকরিটাও ছেড়ে দিলেন। তখন তাঁর ইচ্ছা, নিজে ছবি পরিচালনা করবেন। শুরু করলেন ‘সাধনা’ ছবির কাজ। কিন্তু ছবি শেষ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হলেন। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, স্ত্রীর গয়নাগাঁটি, সব চলে গেল।
পাওনাদারদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর বাবা তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থেকে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দেউলিয়া মোহিনী চেতলায় এক ভাড়াবাড়ির এক কামরার ঘরে কোনও রকমে মাথা গুঁজলেন। দুধের শিশু নিয়ে অসম্ভব দারিদ্রের সঙ্গে নিয়ত যুঝছেন যখন, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মুখ ফিরিয়ে নিল তাঁর থেকে।
১৯৫৪ সালে কলকাতা ছেড়ে মোহিনী চৌধুরী চলে গেলেন দিল্লি— বিজ্ঞানী তথা সাংসদ মেঘনাদ সাহার সংসদীয় সচিবের পদ নিয়ে। ভেবেছিলেন কলকাতা আর এখানকার সংস্কৃতি-জগতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দেবেন। কিন্তু মন টিকল না দিল্লিতে। তত দিনে ‘সাধনা’র মুক্তির সময় হয়েছে। সিনেমা ফ্লপ হল। মেঘনাদ সাহাকে কিছু না জানিয়েই হঠাৎ একদিন চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এলেন মোহিনী।
দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তখন বেশ কিছু সিনেমার প্রযোজক। পরিচয় করিয়ে দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্ত ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবির জন্য দুটো গান লিখতে বললেন মোহিনীকে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল’ আর ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল’, দুটো গানই সুপারহিট। এর পর ‘শুকসারী’ ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে মোহিনীর লেখা গান গাইলেন মান্না দে— ‘সখি চন্দ্রবদনী, সুন্দরী ধনি…’
এই গান ক’টিই মোহিনীর লেখা শেষ সাড়া জাগানো গান। দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের চাকরিটা যখন চলে গেল, তখন তাঁর বয়স একান্ন। ফের অসহনীয় দারিদ্র। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বাংলা গানের জগতের জ্যোতিষ্ক ছিলেন এক সময়। ভেবেছিলেন, সেই সময়ের খানিকটা আলো শেষ জীবনে ছুঁয়ে যাবে। সেই আশা পূর্ণ হয়নি। দিন গুজরানের জন্য কাজ করে গেছেন বৃদ্ধ বয়সেও। না পেয়েছেন সম্মান, না সাম্মানিক।
১৯৮৭ সালের ২১ মে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় মোহিনী চৌধুরীর।
মোহিনী চৌধুরী ১৯২০ সালের আজকের দিনে (৫ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment