#বিদায়_বন্ধু!!!
=========।।
প্রবীর রায় : প্রযোজক, পরিচালক, ও অভিনেতা ১৯ নভেম্বর, ২০২৪। আজ আমাদের জীবনে একটা আনন্দের দিন। আমার ছেলে নীলের আজ ৬ষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকী। কাল রাত থেকেই ছোট ছোট কতো আনন্দের মুহুর্ত… আড্ডা, হৈচৈ… আজ সারা দিন ধরেই কতো প্ল্যান…!
এরই মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। ঘন্টা কয়েক আগে খবর পেলাম- ভরত আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আজ ভোরেই। ভরত… ভরত দেববর্মা… মুনমুন সেনের “হাবি”… সুচিত্রা সেনের জামাতা। খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জানতাম – ইদানীং একটু অসুস্থ ছিল। তবু, বন্ধুর চির-বিদায়ের খবরটা নিমেষে মনকে বিষন্ন করে তুললো। মনে পড়ে গেলো কত মন ভালো করা স্মৃতি। নীরবে ছুঁয়ে এলাম মুনমুন আর ভরতকে। অনেক মানুষ থাকেন যাঁরা রক্ত সম্পর্কিত না হয়েও আমার আত্মার আত্মীয়। এই দুজন সেরকম দুই বন্ধু।
মুনমুনের সঙ্গে আলাপ ১৯৮৬ সাল নাগাদ। ধারাবাহিক” বিচিত্র তদন্ত”-তে শার্লক হোমসের একটা বিখ্যাত গল্প ছিল “Scandal in Bohemia “। সেই গল্পটার জন্য একজন খুব সুন্দরী নায়িকার দরকার ছিল। কাকে নেওয়া যায়!! পরিচালক ইন্দর সেনের পছন্দ মুনমুন সেন। একদিন আমি আর চাঁদুদা মুনমুনের বাড়ি চলে গেলাম Harrington Mansion এ। সেই প্রথম মুনমুনের সঙ্গে আলাপ। শুনেছিলাম- ও খুব whimsical। এই গল্পে মুনমুনের বিপরীতে অভিনয় করলাম আমি। মুনমুনের প্রথম টিভি সিরিয়াল এপিয়ারেন্স- অসাধারণ অভিনয় করেছিল। সেই শুরু। তারপর একটানা বন্ধুত্বের উদযাপন।
“বিচিত্র তদন্ত” শেষ হওয়ার আগেই আমি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদাহ-র স্ক্রিপ্ট জমা দিয়েছিলাম। ডিরেক্টর ছিলেন প্রথমে সুজিত গুপ্ত। পরে আসেন ইন্দর সেন। আমি প্রথম থেকেই অচলার চরিত্রে মুনমুনকে ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু ও খুবই দ্বিধান্বিত ছিল। কারণ যে চরিত্র মা করেছেন, সেই চরিত্র করার সাহস ওর নেই। সে সময় আমি ছাড়াও ভরত খুব বুঝিয়েছিল ওকে রাজি করাতে। পুরো গৃহদাহ শুটের সময়ে ভরত খুব উৎসাহ দিত মুনমুনকে। আমাদের একটা দারুন গ্রুপ ছিল। আমি আর আমার বউ ছাড়া, সুব্রত দা, আলপনা গোস্বামী, লক্ষণ সিং, চিত্রা, পার্থ তালুকদার, নিনা তালুকদার, সোমা চ্যাটার্জী।
“গৃহদাহ”র শুটিং শুরু হলো, যেন একটা পরিবার। মুনমুন নিজের কস্টিউম design করার দায়িত্ব নিয়ে নিলো। “গৃহদাহ” তে ওর প্রত্যেকটা Dress এর design ওর নিজের করা। প্রায় প্রতি শনিবার ভরত, ভরতের এক বন্ধু কিষান আসতো শুটিংয়ে। আর মাঝে মাঝে আমাদের গেস্ট হতেন সুব্রতদা (সুব্রত মুখার্জী), হৈ হৈ করে শুটিং হতো। আর শুটের পর রাতে প্রায়ই মুনমুন, হাবির বাড়িতে আড্ডা আর সঙ্গে ডিনার।
উত্তমকুমারের বাড়ির মতো মুনমুনদের বাড়ি থেকেও ডিনার না করে কেউ আসতে পারতেন না। আর সমস্ত মেনুর তদারকি করত হাবি। ঐরকম অতিথিবৎসল, শিক্ষিত , ভদ্রলোক আমি আমার জীবনে খুবই কম দেখেছি। আর থাকবে নাই না কেন , রাজপরিবারের রক্ত তো ছিল ওঁর শরীরে। উত্তমকুমার হাবির খুব প্রিয় ছিলেন। আমার কাছে খালি জিজ্ঞাসা করতেন ওনার কথা, ওনার বাড়ির আড্ডার কথা। মুনমুনের কাছে শুনেছি হাবি ওর শাশুড়ির খুব প্রিয় ছিল। মনে আছে, যখনই মুনমুনকে বলতাম , তোমার মার সঙ্গে একদিন আলাপ করিয়ে দাও প্লিজ। সবসময়ে ও বলতো, সেটা করানোর ক্ষমতা একমাত্র হাবির ই আছে। শেষপর্যন্ত সেই আলাপ আর হয়নি।
অগ্নিদেবের “চৌধুরী ফার্মাসিউটিক্যাল” এর শুটের সময়েও আমরা রেগুলার মিট করতাম, কখনো টলিক্লাব, কখনও স্যাটারডে ক্লাবে। আমার আর পপাই এর সঙ্গে ছিল অসম্ভব বন্ধুত্ব .. ..আমরা ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছিলাম! মুনমুনের দুই মেয়ে ডলু(রাইমা) আর বুড়ি(রিয়া) তখন কতো ছোট।
গৃহদাহর শুটিং চলাকালীন আমি আর মুনমুন ঠিক করলাম, আমরা একটা কোম্পানি তৈরি করবো নিয়মিত ধারাবাহিক প্রোডিউস করার জন্য….ন্যাশনাল আর কলকাতায় । মুনমুন, ভরতের সঙ্গে কয়েকটা মিটিং করে আমরা কোম্পানির নাম ঠিক করলাম “Moon Vision Private Limited “. আমি, মুনমুন, ভরত আর আমার স্ত্রী পপাই (সোমাশ্রী)চারজন ডিরেক্টর। কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে “Moon Vision Private Limited ” রেজিস্টার্ড হয়ে গেলো। প্রথম সিরিয়াল পরিচালনা করার কথা ছিল প্রভাত রায়ের ।
এই কোম্পানীর কাজ নিয়ে দিল্লী গেছি- আতিথ্য গ্রহণ করেছি হাবির বোন দেবযানীর। ও দিল্লীতে থাকতো। অসাধারণ সময় কাটিয়েছি মুনমুন আর হাবির সঙ্গে। সঙ্গে সুব্রত মুখার্জী। ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ মুনমুনের বাড়িতেই। কত আড্ডা। কলকাতায়, দিল্লিতে। সব আজ স্মৃতি হয়ে গেলো।
নিয়মিত যোগাযোগ ছিল মুনমুন আর ভরতের সঙ্গে। অবশ্য মুনমুন সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেবার পর দেখা-সাক্ষাৎ কমই হতো। সম্প্রতি বেশ কয়েকবার মুনমুন আর হাবির পক্ষ থেকে ওদের বাড়ি যাবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। ‘যাচ্ছি- যাব’ করে আর হয়ে ওঠেনি । এর মধ্যেই আজ সকালের এই মর্মান্তিক খবর…
বিষন্ন মন আর ভেজা চোখে বলি – হাবি! তোমার মতো বন্ধু বৎসল মানুষকে এতো বছর কাছে পেয়ে আমি ধন্য।
আজ কিচ্ছু বলার নেই আমার। নতুন ঠিকানায় ভালো থেকো। এইটুকুই আজ বলতে চাই !
Be First to Comment