শু ভ জ ন্ম দি ন পে লে
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘কালো মানিক’ খ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। পেলে খেলেছেন এমন কোনো টুর্নামেন্টের সর্বকালের সেরা একাদশ থেকে মনে হয় তাকে বাদ দেয়া যাবে না। শুধু ফুটবলারই নন, জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী এক যোদ্ধার নাম ‘পেলে’।
দরিদ্র পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে অভাব অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলাতেই পেলেকে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়। এর সাথে রেলস্টেশনে ঝাড়ু দেবার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিস্কার করার কাজও করেছিলেন। পেলের পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্তো’। নামটা রাখা হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামের সাথে মিল রেখে।
ফুটবলে সহজাত প্রতিভা ছিল তার। ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বিধায় মোজার ভেতরে কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চালাতেন অনুশীলন। ব্রাজিলের অন্যান্য খেলোয়াড়ের মতোই গলির ফুটবলে পেলের প্রতিভা ফুটে উঠে। মাত্র ১৫ বছরের পেলের উপর নজর পড়ে সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর।
ব্রিটো পেলেকে গলি থেকে নিয়ে যান সান্তোস ক্লাবে এবং সান্তোসের ‘বি’ টিমে তাকে সুযোগ দেন। এখানেও সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মাঝে সান্তোসের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন তিনি।
পেলে যখন সান্তোসের মূল দলে যোগ দেন, তখন তার বয়স ১৬ বছর। সেবার ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে সান্তোসের হয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন তিনি। সেবারের ব্রাজিলিয়ান লীগে পেলের পারফরম্যান্স এতটাই নজরকাড়া ছিল যে, তা স্বয়ং ব্রাজিল সরকারেরও চোখ এড়ায়নি।
পেলের এই পারফর্মেন্স তাদের কাছে অমূল্য হিসেবে বিবেচিত হলো। তাই আইন করে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল! রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো জায়ান্টরা তাকে দলে নিতে চাইলেও সরকারের অনুরোধে ইউরোপিয়ান লীগে পেলের কোনো দিন খেলা হয়নি।
পেলের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য ‘পেলে ল’ নামে একটি আইন ব্রাজিলে কার্যকর হয়েছে ২০০১ সালে ব্রাজিল ফুটবলে দুর্নীতির বিচারের জন্য!
অসাধারণ ব্যক্তি হিসেবেও পেলের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তখন ইউরোপে খেললে স্বাভাবিকভাবেই অনেক টাকা আয় করা যেত, কিন্তু সরকারের অনুরোধে দেশের স্বার্থে সেটা হাসিমুখে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
পেলে ভুলে যাননি তার নিজের দারিদ্র্যে ভরা শৈশবকেও, ব্রাজিলের দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে খেলোয়াড়ি জীবনেই গড়েছেন বিশেষ ফাউন্ডেশন। আর খেলা ছাড়ার পর কখনো ইউনিসেফের বিশেষ দূত, কখনো জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত, কখনো বা ব্রাজিলের ‘বিশেষ’ ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তাদের সাহায্য করতে।
বৈশ্বিক কর্মকান্ডেও পেলের কিছু খ্যাতি আছে। একবার পেলে নাইজেরিয়ায় গিয়েছিলেন। সে সময় নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছিলো। শুধুমাত্র পেলেকে দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলগুলো ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল!
রুপালী পর্দাতেও পেলেকে দেখা গিয়েছে। ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলিয়ান টেলিভিশনের ধারাবাহিক ওস এস্ত্রানহোতে প্রথম দেখা গিয়েছিল কালো মানিককে। হলিউডের ছবি ‘এসকেপ টু ভিক্টোরি’-তে মাইকেল কেইন, সিলভেস্টার স্ট্যালোনদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক যুদ্ধবন্দীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন পেলে।
১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বিংশ শতাব্দীর ১০০ জন মানুষের তালিকায় জায়গা পান পেলে।
ব্রাজিলের হয়ে পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সময়টা ছিল ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে গেলেও প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব- রেকর্ডটি করতে ভুল করেননি পেলে।
১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে তিনি অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড। পুরো ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৯২টি হ্যাট্রিক, ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৭৭ গোল), ক্যারিয়ারে ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮৩ গোল- এই পরিসংখ্যানগুলো তার অর্জনের খুব সামান্যটুকুই বোঝাতে পেরেছে।
পেলের যুগে ইউরোপিয়ান নন এমন খেলোয়াড়দেরকে ‘ব্যালন ডি অর’ সম্মাননা দেয়ার নিয়ম ছিল না। ২০১৬ সালে ব্যালন ডি অর এর ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান নন এমন খেলোয়াড়দেরকেও বিবেচনায় এনে নতুন করে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। ১৯৭০ এর ব্যালন ডি অর জয়ী ঘোষণা করা হয় পেলেকে।
তিনটি বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র খেলোয়াড় পেলে, এই একটি কথাই তার অর্জনকে অনেক উপরে তুলে দেয়। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রতিটি বিশ্বকাপেই ফেভারিট হিসেবে যাত্রা করে ব্রাজিল। কিন্তু পেলে আসার আগে ২৮ বছর বিশ্বকাপ জিততে পারেনি তারা। পেলে যাওয়ার পরেও পরবর্তী বিশ্বকাপ জেতে ২৪ বছর পরে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্রাজিলের মতো দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা যেনতেন বিষয় নয়। সেই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ে একটি অ্যাসিস্ট দিয়ে শুরু করেন। কোয়ার্টারে ওয়েলসের বিরুদ্ধে পেলের একমাত্র গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালে পৌঁছে। এই গোল করে বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৩৯ দিন) গোলদাতা হিসেবে রেকর্ডবুকে নাম লেখান পেলে।
সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৪৪ দিন) হ্যাটট্রিকদাতার রেকর্ড করেন। ফাইনালেও দুই গোল করেন। সেই বিশ্বকাপের ‘সিলভার বল’ ও ‘সিলভার বুট’ দুটোই জেতেন পেলে। এছাড়া সেই বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কারও জেতেন তিনি।
পেলে ১৯৪০ সালের আজকের দিনে (২৩ অক্টো) ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment