————জন্মদিনে স্মরণঃ প্রেমেন্দ্র মিত্র———–
“কুঁড়েমি মানে তো মনের শূন্যতা নয়, অসীম রহস্যে ডগমগ মনের নিথর নিটোল পূর্ণতা।” ------- প্রেমেন্দ্র মিত্র।
বাবলু ভট্টাচার্য : সারা জীবন বেঁচেছেন নিজের মতো করে, নিজস্ব শর্তে। তাঁর সাহিত্যকৃতিও একক, স্বতন্ত্র। ছোট গল্প, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা, বিজ্ঞান-সাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য— কী লেখেননি প্রেমেন্দ্র মিত্র?
প্রেমেন্দ্র মিত্র! ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’-এর ছোট গল্প লেখক, বুদ্ধদেব বসু-সমর সেনের সঙ্গে ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পাদনা করা প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-এর স্রষ্টা, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘সাগর থেকে ফেরা’র কবি। ‘পথ বেঁধে দিল’, ‘কালো ছায়া’, ‘হানাবাড়ি’র মতো ছবির পরিচালক, ‘ওরা থাকে ওধারে’র গীতিকার-চিত্রনাট্যকার। আনন্দ পুরস্কার থেকে সাহিত্য অকাদেমি, নেহরু অ্যাওয়ার্ড থেকে দেশিকোত্তমে বন্দিত সাহিত্যিক। মামাবাবু, পরাশর বর্মা বা অমর ঘনাদার মতো চরিত্রের, দুর্দান্ত বিজ্ঞান- সাহিত্যের জিয়নকাঠি যাঁর হাতে, সেই প্রেমেন্দ্র মিত্র। চিরকালই নিজের শর্তে বেঁচেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর সাহিত্যকৃতিও একক, স্বতন্ত্র। বলা যাবে না যে তিনি ‘অমুকের মতো’ লিখতেন। রবীন্দ্রধারার বিপরীতে ‘কল্লোল যুগ’, এ রকমটা সাহিত্যের ইতিহাসে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।প্রেমেন্দ্র মিত্র কিন্তু লিখে গিয়েছেন আসল কল্লোল-কথা, ‘বহু বিচিত্র অমিলকে মেলাবার একটি পতাকা’ ছিল ‘কল্লোল’, ‘সেখানে মিল ছিল না শৈলজানন্দ আর অচিন্ত্য সেনগুপ্তের লেখায়। বুদ্ধদেব আর যুবনাশ্ব ছদ্মনামে মণীশ ঘটক সম্পূর্ণ ভিন্ন কলমে লিখত।

সাহিত্যে অশ্লীলতা নিয়ে যখন সে যুগে সমাজমন তোলপাড়, প্রেমেন্দ্র মিত্র উচ্চারণ করেন শুধু একটি অমোঘ বাক্য, ‘আশঙ্কাটা সাহিত্যের অশ্লীল হয়ে ওঠা নিয়ে নয়, অশ্লীলতার সাহিত্য সাজবার চাতুরি ও স্পর্ধা দেখে।’ বলিষ্ঠ কলমের মানুষটা কত কিছু যে লিখেছেন— ছোট গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা, ছড়া, কৌতুক, রম্যরচনা, গোয়েন্দা কাহিনি, বিজ্ঞান-সাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য। বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছে গ্রীষ্মে ছায়া, ঝড়বাদলে ত্রাণ, শীতে ওম পেয়েছে। উত্তরপ্রদেশের রুখুসুখু মির্জাপুরে রেল হাসপাতাল কম্পাউন্ডে তারের বেড়ায় ঘেরা শৈশব, বিংশ শতাব্দী শুরুর দশকে। পেশায় ডাক্তার দাদু রাধারমণ ঘোষকে লোকে বলত সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। বসন্ত রোগে তিনি মারা যাওয়ার পর মির্জাপুরের পাট চুকিয়ে ঠাকুমার সঙ্গে পাড়ি— ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের লুপ লাইনের ছোট্ট স্টেশন, বীরভূমের নলহাটি। রেলের ওয়াগনে বাক্সপ্যাঁটরা পোঁটলাপুঁটলির সঙ্গে ঠাকুমা নিয়ে এসেছিলেন বিরাট একটা পাথরের চাঁই! মির্জাপুরের স্মৃতি। সেই পাথর পরে কলকাতার বাড়ির প্রাঙ্গণেও স্থান পেয়েছিল। ভবানীপুরে সাউথ সুবার্বান স্কুলে ভর্তি হওয়া, বন্ধু হল উদ্দাম প্রাণশক্তির এক ছেলে— দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। ভবিষ্যতের অনন্য ভাস্কর-চিত্রকর দেবীপ্রসাদের সঙ্গেই গড়ের মাঠে বায়োস্কোপ দেখা, বড় আর বেপরোয়া হওয়ার স্বাদ। এরই মধ্যে জীবনে এসেছে বই। জুল ভার্ন, চার্লস ডিকেন্স, এমনকী ইঙ্গারসোলও! ইস্কুলে কিন্তু সেই ছেলেই নীলডাউন হয়ে থাকে। এক দিন পণ্ডিতমশায়ের হঠাৎ চোখে পড়ল, প্রেমেন্দ্র খাতায় কবিতা লিখেছে। কী আশ্চর্য, বকেননি, বরং নীলডাউন থেকে তুলে বেঞ্চিতে ফেরত পাঠালেন। এক জীবনে কত কিছু করা যায়? কত কী পড়া যায়? চোদ্দো বছর বয়সে ‘ফার্স্ট ক্লাস’-এ উঠে গিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। কিন্তু ষোলো না হলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। খুব ভাল রেজাল্ট ছিল। হেডমাস্টারমশাই প্রেমেন্দ্রকে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর ইচ্ছে, ফুটবল খেলবেন মন দিয়ে। পরে ঠিক করলেন, ডাক্তার হবেন। গোড়ায় স্কটিশে আর্টস নিয়ে, পরে আশুতোষ কলেজে (তখন নাম সাউথ সুবার্বান কলেজ) সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হলেন।

১৯২২, স্বাধীনতার আন্দোলন জমাট বাঁধছে তখন। ইচ্ছে পাল্টাল আবারও, কৃষিবিদ্যা শিখবেন। পোঁটলায় দু’-একটা জামাকাপড় বেঁধে শ্রীনিকেতন চলে গেলেন। আমি পড়তে চাই, কিন্তু টাকা দিতে পারব না। ভর্তি হওয়া গেল। ভোর পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু। প্রতি ছাত্রের জন্য তিন কাঠা জমি বরাদ্দ, একটা ফসল ফলাতে হবে তাতে। জল বয়ে আনা, মাটি খোঁড়া, সার দেওয়া, বীজ লাগানো। শীতের রাতে ফিতের খাটিয়ায় একটি মাত্র কম্বল জড়িয়ে শোওয়া। তোশক, বালিশ নেই, জানালা খোলা! শ্রীনিকেতন ছেড়ে চলে এলেন। এ বার ডাক্তারি পড়তে ঢাকা শহরে। ভর্তির ক্ষেত্রে ঢাকার ছেলেদের অগ্রাধিকার, পরে অন্য ছেলেদের। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেন সায়েন্স নিয়ে। ছুটিতে মাঝে মাঝে কলকাতা। তখন ঠাকুমা থাকেন কাশীতে, কলকাতার বাড়ির প্রায় পুরোটাই ভাড়া দেওয়া। ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে গোবিন্দ ঘোষাল লেনের একটি মেসে থাকার সময় ঘরের জানলার ফাঁকে একটি পোস্টকার্ড আবিষ্কার করেন। চিঠিটা পড়তে পড়তে তার মনে দুটো গল্প আসে। সেই রাতেই গল্পদুটো লিখে পরদিন পাঠিয়ে দেন জনপ্রিয় পত্রিকা প্রবাসীতে। ১৯২৪ সালের মার্চে প্রবাসীতে ‘শুধু কেরানী’ আর এপ্রিল মাসে ‘গোপনচারিণী’ প্রকাশিত হয়। সেই বছরেই কল্লোল পত্রিকায় ‘সংক্রান্তি’ নামে একটি গল্প বেরোয়। এরপর তার মিছিল এবং পাঁক (১৯২৬) নামে দুটি উপন্যাস বেরোয়। পরের বছর বিজলী পত্রিকায় গদ্যছন্দে লেখেন ‘আজ এই রাস্তার গান গাইব’ কবিতাটি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম কবিতার বই ’প্রথমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। বৈপ্লবিক চেতনাসিক্ত মানবিকতা তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রথম জীবনে তার ছোটোগল্পের তিনটি বই বেরোয় – ‘পঞ্চশর’, ‘বেনামী বন্দর’ আর ‘পুতুল ও প্রতিমা’। মানুষের সম্পর্কের ভাঙ্গা গড়া, মনের জটিলতা, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ব্যথা বেদনার কথা প্রকাশে প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন স্বকীয়তায় অনন্য। সেই প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৪টা ছবি পরিচালনা করেছিলেন নিজের কোম্পানি ‘মিত্রাণী’র ব্যানারে। অনেক ছবির গল্প, চিত্রনাট্য, গান লিখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘পথ বেঁধে দিল’ খুব নাম করেছিল। সবিতা বসু, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল বাড়িতে আসতেন।সারা সপ্তাহ সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বিরাট একটা গাড়ি ছিল, হাম্বার সুপার স্নাইপ। এক জন ড্রাইভার ছিল, তিনশো টাকা মাইনে, সঙ্গে থাকা-খাওয়া। মনে আছে, তখন দশ টাকায় এক গ্যালন, মানে সাড়ে চার লিটার পেট্রল পাওয়া যেত। সেই তিনিই ছবি করা ছেড়ে আবার লেখালিখিতে ফিরলেন। সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সিনেমায় যখন গেলেনই, আবার ফিরে এলেন কেন? প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন, ‘‘ফিরে এলাম বলেই তো আমাকে আবার সাহিত্যে পেলে!’’

প্রেমেন্দ্র মিত্র সৃষ্ট জনপ্রিয়তম চরিত্র ঘনাদা, গল্পবাগীশ সর্বজ্ঞানী মেসবাড়ির ঘনশ্যাম দাস আজো সব বয়েসের পাঠকদের কাছে প্রিয়। তার এই অমর চরিত্র ৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের মেসবাড়ির বাসিন্দা ঘনাদা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে।
এছাড়াও তিনি অনেকগুলি ছোট গোয়েন্দা গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যার মুখ্য চরিত্র পরাশর বর্মা, যে পেশায় গোয়েন্দা হলেও নেশায় কবি। তার সৃষ্ট চরিত্র মামাবাবুকে তিনি বহু এডভেঞ্চার উপন্যাস ও ছোটগল্পে এনেছেন যেগুলি কিশোরদের ভেতর জনপ্রিয় ছিল।
পাকস্থলীর ক্যান্সারের কারণে অসুস্থ হয়ে ৩ মে, ১৯৮৮ মারা যান প্রেমেন্দ্র মিত্র।
প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৯০৪ সালের আজকের দিনে (৪ সেপ্টেম্বর) উত্তরপ্রদেশের বারানসীতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment