Press "Enter" to skip to content

প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ
(পর্ব-০১৬)
“যা বলছি, সত্যি বলছি, আমার মিথ্যে বলার প্রয়োজন হয় না”……।

Spread the love


ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। ২৭, ডিসেম্বর, ২০২০। “যা বলছি, সত্যি বলছি, আমার মিথ্যে বলার প্রয়োজন হয় না” আমার হাতি 'বাদশা'র আসল নাম 'বাচ্চা'। কারণ ও যখন আমাদের বাড়িতে আসে তখন ওর বয়স ন'মাস! কিন্তু হাবভাব টা যেন পাকা গিন্নী! সব ব্যাপারে নাক গলানো, সরি, শূড় গলানো চাই। সিংহের খাঁচার সামনে গিয়ে যতো হমবি তমবি আর নাচন-দোলন। জানে, সিংহ এখন বন্দী, মুক্ত নয়। এখন ওকে ভ্যাংচানো চলে। কিচ্ছু করতে পারবে না। প্রথম যেদিন ও আমাদের বাড়ি আসে তখন নেমেই ও "প্যাঁ----" করে এমন চিৎকার করে যে পুরো পাড়া কেঁপে ওঠে। চার তলায় আমার বিছানার তলায় ঘুমিয়ে থাকতো 'সম্রাট'-সিংহ। ওর ঘুম ভেঙে যায়। রেগে ও খুব জোর গর্জন করে ওঠে। যেন রাজা-মশাই রেগে বলছেন, " কে-রে তুই?? আমার রাজত্বে এসে আমাকে ডিসটার্ব করছিস্ ¡!?? তোর সাহস তো কম নয়!!!"। উত্তরে আমাদের হাতি আরও জোরে জবাব দেয় "প্যাঁ----"। সিংহ অপমানিত বোধ করে, যেন বললো," হা-লু-ম, আয় না কাছে, হবে তোর মালুম"। এভাবে বেশ কিছুক্ষন ঝগড়া চলে পুরো বালীগন্ঞ্জের পাড়াটা কাঁপিয়ে, সবাইকে ভ্যাবাচাকা খাইয়ে। আমরা স্বামী-স্ত্রী দিশেহারা হয়ে খাটের তলায় জড়াজড়ি করে লুকিয়ে পড়ি। জয়শ্রী বলে, "যাও বীরপুরুষ, পরিস্থিতি সামলাও...আমার আঁচলের তলায় লুকোচ্ছ কেন?" আমি বলি,"লুকোচ্ছি কে বললো? একটু জিরিয়ে নিচ্ছি...ঠেকে ঠেকে এক্ষুনি সিংহের গলা ভেঙ্গে যাবে, আর বাচ্চা হাতিও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে...তুমি আমায় পাশে থাকতে দাও...নারী-পুরুষ সমানাধিকার।...খাটের ওপরে, খাটের নীচেও..."। কথাগুলো আমি বলতে পারিনি, বলতে চাইছিলাম। টেলিফোনটা বেজে উঠলো। ভেবেছিলাম পুলিশ। কিন্তু তা নয়, আরও বেদনা দায়ক। পেছনের বাড়ির, নিরীহ প্রতিবেশী। পাড়ার সবার জ্যাঠামশাই, হার্টের রুগী। বললেন- "বাবা প্রদীপ, আরও কয়েকটা বছর বাঁচার ইচ্ছে ছিলো। আমি কী অন্যায়টা করেছি বাবা!! আমার পেছনে পুরো আফ্রিকার জঙ্গলটাকে লেলিয়ে দিলে। !!!" আমি টেলিফোনটা জয়শ্রীকে ধরিয়ে দিই, হেসে বলি, "তোমার ফোন।”

জয়শ্রীর তুলনা হয়না। সাধে কি আমি ওকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করি ? নির্বিকার শিব হয়ে ওর পায়ের তলায় সর্বদা পাপোশের মতো পড়ে থাকি?
ও টেলিফোনে বলে। “ও কিছু না। বাচ্চা-তো, ক্ষিধে পেয়েছে, খেতে চাইছে।”
-“তাই বলে তোমরা ওদেরকে দিয়ে আমায় খাওয়াবে? এই বুড়োর মাংস !?’
-“আপনার চিন্তা নেই, ওরা বাচ্চা, শুধু দুধ খায়।” জয়শ্রী ফোন রেখে আমার দিকে রুদ্র-চক্ষু দিয়ে তাকায়। বলে-"যাও, এবার একটা গরু কিনে নিয়ে এসো। দুধ দুইবে আর ঘুঁটে দেবে। আমি এতে নেই। "বলেই খাটের ওপর উঠে এসে শোয়। আমি জানি, ও রাগ করলে ওরকম বলে, আর করে। এসব সিরিয়াসলি নিতে নেই। নীচে এসে মাহুতকে গম্ভীর হয়ে বলি। -"ও এরকম চিল্লাতা কিউ?"

-উসকা ভুখ লাগা। দুধ পিলানা পরেগা।
-তো পিলাও! দেরী কিউ করতা হ্যায় ?
-লানে গিয়া। শুনলাম আমার এক সহকারী বালতী নিয়ে গেছে, দুধ আনতে। আর অন্য একজন গেছে কলেজ স্ট্রীটে, আখ কিনতে। বাচ্চার জন্য।

-তো আগের থেকে কিনে রাখেনি কেন?
-হাতি যে আজকেই আসবে, জানা ছিলো না। লরিতে করে আসা, আগেই চলে এসেছে।

পেছনে লোকের ভীড় হয়ে গেছে। পাড়ার লোক, সঙ্গে অপরিচিত অনেক। সব্বাই সব কিছু জানেন। বাঙালি তো। একজন বললেন -“পাউডার মিল্কের দুধকে লেবু দিয়ে কাটিয়ে ছানা বানিয়ে দিলে গপ্গপ্ করে খায়। সঙ্গে দুটো কলা, খোসা ছাড়িয়ে চটকে মেখে ..”। আর এক ছুপা রুস্তম বলেন,। ” হাতিরা কলা গাছ খেতে ভালোবাসে । আসামে আমার মামার কলাবাগানের হাজার খানেক কলাগাছ দশটা হাতি এসে এক-ঘণ্টায় সাফ করতে দেখেছি। বাচ্চা হাতির জন্য ছোট ছোট কলাগাছ। ওই যে মঙ্গল-ঘটের পাশে থাকে, সে তো ওই কারণে। গণেশ ঠাকুর তুষ্ট থাকেন।” এমন সময় এক বড় বালতী ভর্তি দুধ নিয়ে আসে আমার সহকারী। মাহুত হাত জোড় করে লোকজনকে বলে-। "আপলোগ 'কিলিয়ার' হো যাইয়ে। নেহী তো পিয়েঙ্গে নেহী"। আমি কিচ্ছু বলিনি। বললেই শুরু হবে ফোড়ন বৃষ্টি। দুএকটা স্যাম্পেল যে আসেনি তাই নয়। কে একজন বললেন,"এ্ঃ, হাতি দেখাচ্ছে। ব্ল্যাক মানি, ব্ল্যাক.."।

আর একজন বললেন “সার্কাস থেকে চেয়ে এনে রোয়াব দ্যাখাচ্ছে। টাকা থাকলে ভুতের বাপেরও শ্রাদ্ধ হয়, গরীবের বুকের রক্ত.… “। কেউ কিন্তু সরছেন না। ভীড় করে বেঁকে দাঁড়িয়ে আমাকে শুনিয়ে মন্তব্য প্রকাশ করছেন। আর কেউ আনন্দ না দিক, হাতি আমায় খুব শান্তি দিয়েছে। আধ বালতী দুধ এক টানে শূড়ে শুষে নিয়ে মুখে শূড় ঢুকিয়ে খেয়ে, বাকী আধ বালতী দুধ শূড়ে টেনে ওই ফোড়নকাটা জনতার দিকে জোরে ফোয়ারা করে ছিটিয়ে ভীড় কাটিয়েছে। পয়সা কিছু নষ্ট হলো বাদশা, কিন্তু দুঃখ নেই। আরও একটা -দুটো শো না হয় খেটে-খুটে বেশি করা যাবে, একটু বেশি ঘাম ঝড়াতে হবে, কিন্তু থ্যঙ্ক ইউ, 'ব্ল্যাক মানি' বলে আমাদের সৎভাবে দিনের পর দিন খেটে, দেশের সম্মান বাড়িয়ে, পবিত্র উপার্জনকে যারা অপবাদ দেয়, তাদের মুখে যে থুতু দিয়েছিস, তাতে আমি শান্তি পেয়েছি।

বাদশা বা বাচ্চা , এখন আর ছোট নেই। আমরা ওর সংসার পাতার ব্যবস্থা করিয়েছি। শুনেছি, সুখে আছে। যাবার আগে ও ওর ফ্যানদের আবদারে অনেক অটোগ্রাফ দিয়েছে। পায়ের তলায় কালি লাগিয়ে কাগজে চেপে ওর অটোগ্রাফ। সেই অটোগ্রাফ নেবার একটা ছবি এই লেখার সাথে দিলাম।

অপবাদ দেওয়া চলবে না।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.