ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। কলকাতা, ৩০, নভেম্বর, ২০২০। একজন বলেছিলেন–“আপনি সাধুবাবা হয়ে ভক্তদের ভড়কে দিলে বিরাট বড়লোক হতে পারতেন। ইনকাম ট্যাক্স, জি.এস্.টি., সব ফ্রী!!মূর্খ! জানে না, সাধুবাবাদেরও ট্যাক্স দিতে হয়; তবে সেটা অন্য ভাবে। গুণ্ডা-পোষার বিল, মাস্তানের মাসোহারা, পুলিশের হাত নিশ পিসের বখশিস্ ফিশ, মন্ত্রীদের মনোরঞ্জন মাশুল, খবরের কাগজে জবর খবরটা কবর দেবার জন্য বিজ্ঞাপন, ইত্যাদি ইত্যাদি কতো কিছু। আরেকজন বলেছিলেন -- আপনি কবি হলে পারতেন, মানাতো ভালো। নানা লোকের নানা সাজেশন আমি এ কান দিয়ে ঢুকিয়ে ও কান দিয়ে বের করে দিই। কিন্তু এই কবি হওয়ার আইডিয়াটা আমায় ভাবিয়ে তোলে। ব্যাটাচ্ছেলে বলে কিনা--আমায় মানাতো ভালো !!! চিন্তায় পড়ি। কি মানাতো? কেন মানাতো? কি কারণে বা কি দেখে আমায় বললো কথাটা? কবিতা ছেড়ে ম্যাজিক দেখিয়ে আমি কী অন্যায়টা করেছি? একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। শক্তিদার কথা। মানে, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা। আমায় খুব স্নেহ করতেন। বলতেন,---"প্রদীপ তুমি আমায় একটা ম্যাজিক শিখিয়ে দাও, আমি তোমায় কবি হওয়া শিখিয়ে দেবো। ম্যাজিক দেখালে মনে হবে সবাই নেশা করে ভুল দেখছে। আমি যা বলবো, সবাই 'গুরু' বলে তাই মানবে। প্লিজ শিখিয়ে দাও।" প্রায়ই বলতেন কথাটা। আমি অবাক হতাম। নেশায় ভুল দেখা মানুষের ভাবনার সঙ্গে ম্যাজিকের মোহময়তাকে কি সুন্দর ওমর খৈয়ামের মতো মিশিয়ে দিতে পারা যায়, তা আমায় হতবাক করতো সবসময়। এবারও করলো। ম্যাজিকের কিছু কৌশল দিয়ে এই উন্মত্ত ভালোবাসার সাহিত্যিক কবিকে না হয় কিছুক্ষণ দৃষ্টি-বিভ্রমে ডুবিয়ে রাখা যাবে, -- কিন্তু কবি হওয়াটা কি একটা শেখার জিনিষ হলো!!?আমার জীবন-যুদ্ধের সিলেবাসেই নেই।
আমার নিরুৎসাহী মুখটা শক্তিদার খেয়ালে এসেছে। বলেন, তুমিতো আবার কে-জানে কি কারণে আবার মাল-টাল, সরি, কারণ সূধা খাও না। তাই অন্য আর কি খাবে বলো?
আমি আমতা আমতা করে শেষে স্পষ্টভবে প্রতিবাদ করি, –কি যে বলেন। আমি পেটুক। জানি এবং স্বীকারও করছি। কিন্তু তাই বলে, ‘ খেতে পারি, কিন্তু কেন খাবো?’ ফিলোসফিটা আমার সঙ্গে ম্যাচ্ করে না। শক্তিদা অভিভূত হয়ে পড়েন। বলেন,--এই তো চাই! মানুষের বিচার-বুদ্ধির ঘণ্ট ঘেঁটে, সব্বার মাথা চিবিয়ে খেয়ে তুমি এক অদ্ভুত শক্তি সঞ্চয় করেছো।...আমি তোমাকে কবি বানিয়েই ছাড়বো। আধুনিক কবি। প্রসঙ্গ এড়াতে আমি অন্য কথায় মোচড় দিই। বলি,--একটা কবিতা লিখেছিলাম--আপনাকে দেখাবো বলে। যদি অনুমতি দেন তো...দেখাতে পারি। ঠাট্টা করছি না। সত্যিই লিখেছি। আপনাকে কেন্দ্র করে। এবার শক্তিদার চমকাবার পালা,--আমাকে নিয়ে কবিতা?!? কী শুনি !! এ চেষ্টা কেউ কখনো করেছে বলে তো শুনিনি!! আজকের এই 'প্রলাপ'-এ আমি শক্তিদাকে নিয়ে সেই কবিতাটা পরিবেশন করবো। বক্তব্য এতে ওই একটাই, আর তাহলো, খেতে পারি কিন্তু কেন খাবো? আমি ম্যাজিশিয়ান না হয়ে হয়তো অন্য কিছু হতে পারতাম; কিন্তু কেন হবো? প্রশ্ন করলে তার জবাব তো পাওয়া চাই। সাসপেন্স কেন থাকবে ? সমর্থন পেতে আমার স্ত্রীর মতামত চাই। আমার স্ত্রী বিড় বিড় করে বলেছিলেন,--"মুরোদ নেই...উনি রোদ পোয়াবেন!!!" কথাটার মানে বুঝিনি, কিন্তু কেন জানি না, আমার গা-পিত্তি জ্বলে উঠেছিলো। খেপিয়ে তোলে। তক্ষুণি কাগজ -কলম নিয়ে বসে পড়ি। এ্ঃ,বলে কিনা মুরোদ নেই। লক্ষ্মণরেখা পার হই না বলে আমি কি শুকনো লঙ্কা ডিঙোতে পারি না? দেখাচ্ছি হাতেনাতে।
কবিতাটার নাম দিয়েছি- “প্রশ্নের পর প্রশ্ন”। এবং সেটা হলো——- দুয়ার আটিয়া ঘুমাইয়া ছিল পাড়া কালো আকাশে চাঁদ তো বটেই,
মেঘে মুড়িয়াছে,
হাতে গোণা কিছু তারা।
এমন সময় ‘ব্রেকিয়া’ সজোরে,’নালিঘাসোপরে’
মারুতী একটী , স্লিপিয়া কিছুটা দূরে;।
‘ব্যাকিয়া’ গাড়িটি, মাথা ঝুঁকাইয়া, এদিক ওদিক
দেখিতে লাগিলো তারা।
চিনি নাই আমি তাদের কেহকে,
একজনকে ছাড়া। বলিলেন তিনি ফিশফিশাইয়া,
“এই বাড়িটাই সেটা!
এ্যাদ্দিন পর, অন্ধকারেও, ঠিক চিনেছি এটা ।
এবার , যতোটা ঝাঁকিয়ে পারো,
কড়া খানাকে খুব জোরসে,
খট্খটিয়ে নাড়ো।”
তীক্ষ্ণ-কণ্ঠ, জড়ানো জিহ্বা,
মনে পরিতেছে আজও।
“অবনী, বাড়ি আছো?”
এখানে কুকুর , সাধারণতঃ , ভীষণ জোরে ডাকে,
কামড়ায় শুনি অচেনা মানুষযাকে,
কিন্তু অবাক কান্ড সেদিন ভাই!!!
ওই রাত্তিরে একটা কুকুরও নাই!!!
“অবনী বাড়ি আছো?”
কাঁচা ঘুম তো, ভাঙ্গিতে সময় লাগে,
ধড়মড়াইয়া উঠিয়া বসিলো রাগে,
“আসছি, আসছি…
দরজা ভাঙবে নাকি ?…
আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও…কে? শক্তি নাকি??”
লেখাটা শক্তিদাকে পড়িয়ে ছিলাম। খুব হেসে ছিলেন। তারপর বলেন,–গণ্ডীর এ-পাশে আমাদের বাড়ি মাঝেমধ্যে এসো। মাছের ঝোল-ভাতই না হয় খাওয়াবো।
বলেছিলাম,–“খেতে পারি, কিন্তু কেন খাবো? পেট ভরে আছে ম্যাজিকে। তবে যাবো, ‘শুচিবাই’,
‘ঘরকুনো’, ‘অপদার্থ’,’রোদে ভয় পাই’ এসব অপবাদ গুলো কাটাতে বেড়াতে যাবো। “
আজ এই পর্যন্ত থাক। পরে আবার লিখবো,
যদি আপনারা বলেন।

Be First to Comment