Press "Enter" to skip to content

প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের ২য়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়……।

Spread the love

রথযাত্রা : কিংবদন্তি তাৎপর্য

বাবলু ভট্টাচার্য : রথযাত্রা হিন্দু সমাজের একটি বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের ২য়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর সাতদিন পর শুক্লপক্ষেরই দশমী তিথিতে রথের ফিরতি টান অনুষ্ঠিত হয়। একে বলা হয় উল্টোরথ।

রথযাত্রা অনুষ্ঠানের পক্ষাধিককাল পূর্বের পূর্ণিমা তিথিতে উপাস্য দেবতার স্নানযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল লোকের সমাবেশে মহাসমাবেশে ও ধুমধামের মধ্যে রথযাত্রা ও ফিরতি রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সর্বত্র রথারোহী দেবতা হলেন প্রভু জগন্নাথ, সঙ্গে বৈমাত্রেয় ভাইবোন বলরাম ও সুভদ্রা। তবে অনেক স্থানেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহের অভাবে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ রথে স্থাপনপূর্বক রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

প্রতি বছর ভারতের উড়িষ্যার পুরীতে অবস্থিত জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ পৃথক পৃথকভাবে ৩টি রথে আরোহণ করিয়ে রথে রশি বেঁধে উপস্থিত ভক্তরা রথ, মন্দির থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরবর্তী, গুন্ডিচা বাড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান। গুণ্ডিচা বাড়িতে ৭দিন অবস্থানের পর বিগ্রহ পুণরায় রথে করে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়, যা উল্টোরথ নামে আখ্যায়িত।

রথযাত্রা আসলে কৃষির উর্বরতা তন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এক ধরনের সার্বজনীন আনন্দোৎসব; যেখানে ধনী-গরিব, উচ্চ- নীচ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবাধ মেলামেশায় মেতে উঠতেন। কারণস্বরূপ বলা যায়, প্রথমত, এটি অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ় মাসে, অর্থাৎ বর্ষাকালে, দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণ ছিলেন গো-পালক এবং বলরাম ছিলেন হলধর, অর্থাৎ যিনি হল দ্বারা জমি চাষ করেন।

কালক্রমে হিন্দুধর্মের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতায় নিজস্ব ঐতিহ্য উচ্চ-বর্ণের হিন্দুরা জগন্নাথ তথা নীলমাধব দেবতাকে আত্মস্থ করে নিজেদের দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এরূপ গ্রহণের পর শুরুতে ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজে, শুধুমাত্র উচ্চ-বর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে রথযাত্রা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আর আদিতে নীলমাধব দেবতা যাদের উপাস্য দেবতা ছিলেন, সেই নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের অচ্ছুৎ অন্ত্যজ বলে রথের রশি ধরার অধিকার থেকে তাদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত করে রাখা হয়।

ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের ফলে পুরীর রথযাত্রা এক নতুন মাত্রা লাভ করে।

কথিত আছে, পুরীতে একবার রথযাত্রা উপলক্ষে দেবতাদের বিগ্রহ রথে আরোহণ করিয়ে রথ যাত্রার জন্য প্রস্তুত। উচ্চ- ধর্মীয় হিন্দু নরনারী, রাজ-কর্মচারীবৃন্দ রথের রশি ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও রথের চাকা নাড়াতে পারেননি।

খবর পেয়ে দেশের রাজা প্রতাপ রুদ্র সপরিষদ এসে রথের রশি ধরে আকর্ষণ করতে লাগলেন; তথাপি রথের চাকা স্থির, নিশ্চল। তখন মহাপ্রভু বললেন- যে শবর বা নিম্ন বর্ণের মানুষদের তোমরা অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছ, তাদের রথের রশি ধরার সুযোগ দাও, তোমাদের শক্তির সঙ্গে ওদের শক্তিও যোগ কর তাহলেই রথ তার গতি ফিরে পাবে।

অনেক টালবাহানার পর সমাজে পিছিয়ে থাকা অচ্ছুৎ অন্ত্যজদের রথের রশি ধরার অনুমতি মিলল। সমাজের অন্য সবার শক্তির সঙ্গে যে মুহূর্তে যোগ হলো তথাকথিত অন্ত্যজদের শক্তি- সবাইকে অবাক করে দেবতার রথের চাকা তখনই সশব্দে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।

এত কিছুর পর, বাংলাদেশসহ বিশাল ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র রথযাত্রাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সমাজের উচ্চবর্গীয় ও অচ্ছুৎ-অন্ত্যজ ব্যক্তিবর্গের অর্থাৎ সবার সমঅধিকার এখনো তেমন বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। অনেক স্থানেই অচ্ছুৎ-অন্ত্যজদের ধর্মীয় সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এখনো মাঝে মাঝেই আইন আদালতের আশ্রয় নিতে হয়।

সামগ্রিক বিচারে রথযাত্রা হলো সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক। সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজের কোনো অংশকে অপাঙ্ক্তেয় করলে, অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রাখলে সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার গতিও রুদ্ধ হয়ে পড়ে; সমাজ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সমাজ তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়।

পক্ষান্তরে সমাজের উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ, জাতি- ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয়, তবেই সমাজ সামনে এগিয়ে চলে।

এক কথায়, রথযাত্রা মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীভাব জাগায়, সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মানুষকে সমষ্টিগতভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে। এই হলো রথযাত্রার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।

শুভ রথযাত্রা।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *