” আজ বিশ্ব অটিজম দিবস “!
—————————————–
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ২ এপ্রিল ২০২২।
প্রতিবছরের মত এবারেও সারা পৃথিবী ব্যাপী আজ ২ এপ্রিল পালিত হচ্ছে “বিশ্ব অটিজম দিবস “৷ অনেকের ধারণা এটা এক জটিল মানসিক রোগ ৷ যদিও এই রোগের কারণ স্নায়বিক বিকাশের সমস্যা বা নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার ৷ এদের ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিক অবস্থার জন্মগত ছাড়াও জন্মের সময়ে নার্ভাস সিস্টেমে আঘাত , গর্ভাবস্থায় মায়ের থ্যালিডোমাইড এবং ভ্যালপোরিক এসিড সেবন এর কারণ ৷ এরা ” 7q11.23″ বহন করে ৷ ক্রোমোজোম কোডিং থেকে আমরা জানতে পারি ৷ স্নায়বিক এই অক্ষমতার জন্য এই রোগীরা অপরের সাথে যথাযথভাবে যোগাযোগ রাখতে এবং সামাজিক সম্বন্ধ তৈরী করতে অপারগ হয় ৷ তাই একে বাংলায় “বহির্বিমুখিতা ” বা আত্মমগ্নতা এবং অসুস্থ কল্পনামগ্নতা বলা হয়েছে ৷ পাঁচ প্রকার অটিজম দেখা যায় ৷ তারমধ্যে
হাই ফাংশনিং অটিজমের থাকে ভাষাগত ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ার অসুবিধা ৷ এসপারজার দের থাকে এসব সমস্যা ৷ অস্বাভাবিক আচরণ থাকলেও এরা মধ্য ও উচ্চমেধার হয় ৷ আর পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার বা PDD-NOS দের থাকে সামাজিক সম্পর্ক ও ভাষার আদান প্রদানে জটিলতা ৷ কিন্তু মানসিক জটিলতা থাকে না ৷ সম্পূর্ণ সুস্থ করা না গেলেও অটিজম তাড়াতাড়ি রোগ ধরা পড়লে ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে এর জটিলতা এড়ানো সম্ভব। অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় ৷ এর জন্য আমরা চিকিৎসকরা ওষুধের পাশাপাশি আচরণগত , ব্যবহারিক বা বিহেভিয়ারেল , কর্মগত বা অকুপেশনাল , সেনসরি ইন্টিগ্রেশন ও স্পিচ থেরাপি করতে বলি ৷ Applied Behavior Analysis ABA অনেকরকম কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৷ বড় কাজগুলিকে ছোট ছোট ভাগে শেখানো হয় ৷ ওষুধ দেওয়া হয় নানা সহযোগী সমস্যা বা কোমর্বিডিটির ৷ বিষণ্ণতা , আগ্রাসী মনোভাব , ঘুম না হওয়া , খিঁচুনি , অতিরিক্ত চঞ্চলতা , স্বল্প বুদ্ধি এবং শারীরিক সমস্যার ৷ যখন তাকে আগ্রাসী আচরণ আটকানো কঠিন এমন চ্যালেঞ্জিং বিহেভিয়ার নিজেকে বা অন্যকে আঘাত করা এসব ক্ষেত্রে ওষুধ ভালো ফল দেয় ৷ মনে রাখা দরকার একেক শিশুর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন ৷ তাই কেস টেকিং করে চিকিৎসা করতে হয় ৷ অভিভাবকদের বুঝতে হবে এর কোন জাদুকরী চিকিৎসা আজও নেই ৷ ধৈর্য চাই ৷

এই জটিল স্নায়বিক বিকাশ সংক্রান্ত রোগের শ্রেণী যা সামাজিক বিকলতা, কথা বলার প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধ, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং একই ধরনের আচরণ দ্বারা চিহ্নিত হয়। এটা একটি মস্তিষ্কের রোগ যা সাধারণত: অটিজম স্পেকটাম ডিসঅর্ডার বা এ এস ডি বলে পরিচিত ৷ এই ধরণের রোগ সাধারণত: শৈশবে শুরু হয় এবং বড় হওয়া পর্যন্ত থাকে “বাচ্চার অটিজম আছে কিনা বোঝা যায় ৷ লক্ষ্য করুন ৷ তবে , ঠিকমতো পরিচর্যা পেলে এরা গান , আঁকা সহ নানা শিল্পকর্মে চমক দেখাতে পারে ৷ সমাজের বোঝা নয় হয়ে উঠতে পারে পরিবার তথা দেশের সম্পদ ৷
একজন এ এস ডি আক্রান্ত শিশুর মধ্যে যা যা দেখা দিতে পারে ৷ তা দেড় থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় ৷
১. ১২ মাস বয়সেও তার নাম ধরে ডাকলে প্রতিক্রিয়া করে না।
২. ১৮ মাস বয়সে খেলতে পারে না।
৩. এরা সাধারণত অন্যের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকানো এড়িয়ে যায় এবং একা থাকতে পছন্দ করে
৪. এই শিশুরা অন্য মানুষের অনুভূতি বুঝতে বা তাদের নিজস্ব অনুভূতি নিয়ে কথা বলতে অসুবিধা অনুভব করে।
৫. দেখুন তারা টিভির প্রিয় অনুষ্ঠান বলতে পারে কিনা ?
৬ . এই শিশুরা দেরী করে কথা শেখে এবং ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না ৷
৭. শব্দ বা ছোটো ছোটো বাক্য বারবার বলতে থাকে (ইকোলালিয়া)।
৮. প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কহীন উত্তর দেয় ৷ যার কোন অর্থ নেই ৷ কোন ছোটখাটো পরিবর্তন পছন্দ করে না।
৯. কিছু বদ্ধমূল আগ্রহ থাকে।
১০. কিছু কিছু সময় তারা তাদের দুই হাতে ঝাপট মারতে থাকে, নিজের চুল ছিঁড়তে থাকে ও তাদের শরীর দোলাতে থাকে, অথবা চক্রাকারে ঘোরাতে থাকে।
১১. কিছু শব্দের, গন্ধ, স্বাদ, চেহারা বা অনুভবের সঙ্গে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
১২. দেখুন তারা তাদের খেলনা বা ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য খুলে লাগাতে পারে কিনা ৷
১৩. সমবয়সী বন্ধুর সাথে মিশতে পারে না ৷
১৪. সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে ৷ আপন মনে চিন্তা করে ৷
১৫. এদের সহনশীলতা কম হয় ৷
১৬. ইশারা করে সব কিছু বোঝাতে চায় ৷
১৭. অনেক সময় মনের ভাবের পরিবর্তন হয় ৷ যা বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আমরা মনোবিদরা দেখি ৷
১৮. মনোযোগের অভাব Attention deficit hyperactive disorder ADHD রোগীর ক্ষেত্রে পাই ৷
বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি আড়াইশো জন শিশুর মধ্যে একজনের অটিস্টিক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ৷ অধিকাংশ সাইক্রিয়াটিক শিশুর সঙ্গে একটা তফাৎ দেখা যায় এরা নিম্ন বুদ্ধিমত্তার হয় না ৷ গড় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হয় ৷ অনেকে উচ্চ বুদ্ধিমত্তারও হয়ে থাকে ৷
বিশ্ব অটিজম দিবসে আমরা সবাই মিলে শুধু অটিজম রোগে আক্রান্ত পরিবারকে নয় সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করে তুলি। আমাদের পরিবারে, প্রতিবেশীদের মধ্যে চারপাশে অথবা গ্রামে শহরে এইরকম পরিস্থিতির শিকার অনেক শিশু। তাদের আগ্রহ ও পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে ৷ অধৈর্য না হয়ে ইতিবাচক হোন ৷ মৃদু অটিস্টিক শিশুরা সাধারণ শিক্ষালাভে সক্ষম ৷ অন্যদের দরকার দলগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ৷
Be First to Comment