নিজস্ব প্রতিনিধি : কলকাতা, ১৫ মার্চ ২০২৩। আমাদের সকলের জীবনের নিজস্ব সংগ্রাম রয়েছে। আমরা অনেক সময় ভেবে থাকি এবং অনুভব করি যে কেন আমরা সেই বাচ্চাদের মতো অতো সুযোগ সুবিধা পাই না, যাদের কাছে সব আছে। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে আমরা বুঝতে পারি আমাদের উপরে আমাদের বাবা – মা এর ছায়া থাকার চেয়ে আর বড় সুখ আর কিছুই নেই। ফারগিনা পারভিন। যার গল্প একটু আলাদা। একজন ২৬ বছর বয়সী মহিলার জীবন চড়াই-উতরাই এর গল্প। তিনি এখন পেশাগত ভাবে আচার্য তুলসি একাডেমি- অর্কিডস দ্য ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের (নিউটাউন) শারীরিক শিক্ষার শিক্ষিকা, যিনি তার পারিবারিক বা পিতামাতার পাশে থাকা ছাড়াই নিজের জীবনকে এই জায়গায় নিয়ে এসছেন এবং জীবনকে শিল্প রুপে আয়ত্ত করেছেন।
১০ বছর বয়সে মাকে হারান ফারগিনা। মায়ের মৃত্যুর এক বছর ঘুরতেই বাবা পুনরায় বিয়ে করেছিলেন এবং তারপরে সব কিছুই বদলে যায়। ফারগিনা এবং তার বোন খেলাধুলায় ভাল ছিলেন। তাদের ইচ্ছা ছিল এই বিষয় তারা প্রতিষ্ঠিত হোক। তাই দুজনেই মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে এবং তারপর বিয়ে করবে, এমনই ভেবেছিলেন। যা এখনও কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে খুব সাধারণ ঘটনা। আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনেকাংশেই মেয়েদের বাবা-মা মনে করেন যে তার পড়াশোনার চেয়ে তার বিয়েতে অর্থ ব্যয় করা ভাল। ফারগিনার বিয়ে দেওয়ার বিষয় তার বাবা-মার কাছে শান্তি ও তৃপ্তির অনুভূতিতে পরিণত হয়েছিল। তার ভাই নুরসেদ আলম শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর ফারগিনা তার নিরন্তর সমর্থন হয়ে ওঠেন এবং বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করেন। ফারগিনা এবং তার বোন সাবিনা ইয়াসমিন যিনি সাঁকোলার একজন শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক, তিনিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ফারগিনার ভাই নুরসেদ সর্বদা দুই বোনের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছেন এবং তাদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে চিন্তা করতে উত্সাহিত করেছেন। ফারগিনা পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় স্তর পর্যন্ত অ্যাথলেটিক্স এবং খো-খো খেলেন এবং অনেক বৃত্তি পেয়েছিলেন যা তাকে তার উচ্চ শিক্ষা শেষ করতে সাহায্য করেছিল। তার পাশে বাবা-মা না থাকায়, ধীরে ধীরে তার মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। তারা তাকে এবং তার বোনকে তাদের লেখাপড়া ছেড়ে বিয়ে করার জন্য অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। পরিস্থিতির ফেরে অবস্থা অন্য রুপ নেয়। তারা তাদের নিজেদের খাবার নিজেরাই যোগার করে এক থালায় ভাগ করে খেত।
২০২০ সালে ফারগিনার বিয়ে হয়। বর্তমানে তার অত্যন্ত সহায়ক স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ি রয়েছে। বিয়ের পর, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি রাজ্য-স্তরের খো-খো চ্যাম্পিয়নশিপে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যেখানে তার দল টুর্নামেন্ট জিতেছিল। ২০১৮ তে তিনি আন্তঃ কলেজ জেলা ক্রীড়া ও গেমস চ্যাম্পিয়নশিপ খো-খো তে চ্যাম্পিয়ন হন। পশ্চিমবঙ্গ ইন্টার কলেজ স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮ (খো-খো) তে অংশগ্রহণকারী এবং আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় খো-খো চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২- এর বিজয়ী হন।
ফারগিনার মতই তার ভাই-বোন চাকরি করছেন এবং তার মা-বাবা বর্তমানে মানসিক ভাবে অনেকটাই বদলেছেন। এখন তারা তাদের সন্তানদের আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহিত করতে অন্য অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত, ফারগিনা তার অতীতের কথা ভাবতে গিয়ে মানসিক আঘাত পায়, কীভাবে সে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিল এবং তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়েছিল কিন্তু সে জানে কীভাবে লড়াই করতে হয় এবং কখনো হাল ছেড়ে দেয় না।
Be First to Comment