—–জন্মদিনে স্মরণঃ নেলসন ম্যান্ডেলা (মাদিবা)—
“তুমি অমর কবিতার অন্ত্যমিল
তোমার চোখে দেখি স্বপ্ন-মিছিল”
বাবলু ভট্টাচার্য : সাদা চামড়ার ঔপনিবেশিক শোষকদের দ্বারা লালিত বর্বর বর্ণবাদকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সকল জাতি-বর্ণের মানুষকে তিনি শিখিয়েছেন ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সংহতির মহৎ আদর্শ। এইভাবে তিনি হয়ে উঠেছেন কেবল দক্ষিণ আফ্রিকারই নয়, সারা বিশ্বের মানবজাতির মুক্তির সেনানী, অগ্রপথিক। সেই মহানায়ক হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা— যিনি ‘মাদিবা’ নামেও পরিচিত। বর্ণবাদ ছিল শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদীদের মতাদর্শগত হাতিয়ার। ম্যান্ডেলা তরুণ বয়স থেকেই বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনে নাম লেখান। ম্যান্ডেলার ৯৫ বছরের জীবদ্দশার ২৭ বছরই কেটেছে কারাগারে। ১৯৯৪ সালে প্রথম নির্বাচিত কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিশোধের পথে না হেঁটে সমঝোতার পথেই হেঁটেছিলেন তিনি। নিজে মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হলেও সেধরনের সংস্কার আনার চেষ্টা করেননি। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে ১৯৯৯ সালে অবসর নেন তিনি। ২০১০ সালে জাতিসঙ্ঘ ১৮ জুলাইকে ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন বৈষম্য আর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই বিশ্বনেতা।
তাঁর বহু সম্মাননা আর পুরস্কারের মধ্যে নোবেল পুরস্কার অন্যতম। শান্তির পথে আলোচনার মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যার সমাধান আনার জন্য ১৯৯৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় তাঁকে। সেই সময় কৃষ্ণ-আফ্রিকানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার হয়নি। অল্পসংখ্যক আফ্রিকান, যারা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন ম্যান্ডেলা তাদের একজন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি লাভ করেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন জোহেন্সবার্গে। এই সময় তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (ANC) যোগদান করেন; ১৯৪৪ সালে। নেলসন ম্যান্ডেলা একই সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন এবং নেতৃত্ব প্রদান করেন, যে কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্যাসিস্ত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলায় ‘শ্রমিকদের উসকানি’র অভিযোগও এনেছিল। ১৯৬১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা আত্মগোপনে যান। ১৯৬২ সালে গ্রেফতার হবার সময় তিনি কেবল এএনসির নেতা ছিলেন তাই-ই নয়, তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন। সিআইএ তাদের বন্ধু সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারকে তথ্য সরবরাহ করে এবং তারই ভিত্তিতে ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রিটোরিয়ায়। বর্ণবাদী ফ্যাসিস্তদের বিচারে তাঁকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড (১২ জুন, ১৯৬৪)। ২৭ বছরের জেলজীবনে তাঁকে অধিকাংশ সময় নিঃসঙ্গ থাকতে হয়েছিল। নির্যাতনও কম হয়নি। ওরা তাঁকে মেরেই ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসীবাদের ইচ্ছানুযায়ী ইতিহাস পরিচালিত হয় না। এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ সংগ্রাম, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের কার্যকর সহযোগিতা, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের দৃঢ় সমর্থন এবং বিশ্বজনমতের পরিপ্রেক্ষিতে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্যাসিস্ত সরকার পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৯০ সালে মাদিবা মুক্তিলাভ করেন।কারাগারে থাকলেও নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের হৃদয়ে। তিনি ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামীদের প্রেরণাদাতা। ১৯৯৪ সালে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসনের বদলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ম্যান্ডেলা ছিলেন প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৯ সালে তিনি বয়সের কারণে স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে আসেন।
গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে গণ্য ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারত সরকার প্রদত্ত ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কার ও ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল শান্তি পুরস্কার। তাছাড়াও তিনি ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন।
৫ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে ৯৫ বছর বয়সে তিনি জোহানেসবার্গ গাউটেং, দক্ষিণ আফ্রিকায় মৃত্যুবরণ করেন।
নেলসন রোলিহালালা ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের আজকের দিনে (১৮ জুলাই) দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সকিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment