Last updated on October 27, 2022
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৬ অক্টোবর, ২০২২। কালী পুজো অমাবস্যায়। পরের দিন পঞ্জিকা মতে প্রতিপদ। এদিন পূর্ব বঙ্গীয় হিন্দু বাঙালিরা ভাইফোঁটা পালন করেন । এদেশীয় হিন্দু বাঙালিরা ভাইফোঁটার উৎসব পালন করেন পরেরদিন ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ায়। দিদি , বোন ভাই বা দাদার শতবর্ষের আয়ু কামনা করে উপোষ করে ফোঁটা দেন। পরিবর্তে ভাই বা দাদা দিদির আশীর্বাদ নেন, বোনদের আশীর্বাদ করেন। উপহার দেওয়া নেওয়া করেন। ভাইবোনের সম্পর্কের এক মধুর বন্ধনের ছবি ফুটে ওঠে । আবার এটাও ঠিক, বিয়ের পর পিতার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে বিবাদের ফলে ভাই ফোঁটা দূরের কথা, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেছে, এমন ঘটনাও বিরল নয়। স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে গেছে শৈশবের স্মৃতি। যে কোনো সামাজিক উৎসব বা অনুষ্ঠানের পেছনে কার্যকারণ থাকে। সেটাই স্বাভাবিক।
প্রায়শই শোনা যায় , রাখী বন্ধন ও ভাইফোঁটা সংসারের পুরুষ সদস্যের মঙ্গল কামনায়। পরিবারের পুরুষরা কি কোনো মহিলা সদস্যদের মঙ্গল কামনায় উৎসব করেন? কেন নেই বোনফোঁটা? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক। আসলে প্রাচীন সমাজে পুরুষরা বেশি বয়সেও অনেক বিয়ে করতেন। সন্তান ছোট থাকতেই অনেক পিতা মারা যেতেন । ছোট বোন বা দিদির দায়িত্ব বর্তাতো ভাই বা দাদার ওপর। সুতরাং সেযুগের নারীর অভিভাবকত্ব পিতার অবর্তমানে ভাই বা দাদার হওয়ায় মেয়েরা দাদা বা ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করতো নিজেদেরই নিরাপত্তার খাতিরে।
নারীর অভিভাবকত্ব যেহেতু পুরুষের হাতে ন্যস্ত, সেহেতু নারীর অস্তিত্ব ক্রমশ পুরুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তার প্রভাবেই সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি পুরুষকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।বিদেশের কথা বা অন্য ধর্মে পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব সরিয়ে আমাদের দেশেই তাকানো যাক। মনু তো স্পষ্ট বলেছেন, নারী সন্তান উৎপাদনের হাতিয়ার মাত্র। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন,,,,,, বেদেই আমরা দেখি নারী পণ্যবস্তু। বিবাহে, শ্রাদ্ধে, বিজয়োৎসবে, অতিথি আপ্যায়নে, যজ্ঞে, এমনকি নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও নারীকে দান করা হচ্ছে বহুমূল্য অন্য সব বস্তুর সঙ্গে।,,,, ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন, আদিকালে পুরুষ এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল, তাঁরা তখন নারীর সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করার জন্য।( পৃষ্ঠা:১১৮)
আজকের মেয়েরা কি অস্বীকার করতে পারেন, সেযুগের কোনো প্রথা আজও কেন মেনে চলবেন, এমন প্রশ্ন তুলেছেন? হ্যাঁ। কয়েকজন নারী প্রশ্ন তুলেছেন বটে কেন বিবাহে বা পুজোয় নারী পুরোহিত হবে না? কেন জামাইষষ্ঠীর মত বৌমা ষষ্ঠী হবে না? কিন্তু ভাইফোঁটার পাশাপাশি কেন বোন ফোঁটা হবে না এই প্রশ্ন তোলেননি। ভাইয়ের আয়ু কামনা যদি বোন করে থাকেন, ভাইয়েরা কেন বোনের আয়ু কামনা করে বোন বা দিদিকে ফোঁটা দেবেন না? সে প্রশ্ন আজকের শিক্ষিত মহিলা সমাজ তোলেন না। তাঁদের সান্ত্বনা দেবী পুজোর মধ্যেই। অথচ সে দেবীর পুজোর অধিকার নেই। পুরোহিতের আসনে পুরুষ। দেশের উত্তরাঞ্চলে,পশ্চিমাঞ্চলে পালিত হয় করওয়া চৌথ। এই বছর ১৩ ও ১৪ অক্টোবর পালিত হয়েছে। সারাদিন উপোষ থেকে রাতে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে চন্দ্রদেবকে পুজো দিয়ে ছাঁকনিতে স্বামীর মুখ দেখে তাঁকে কপালে টিকা পড়িয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ব্রত সম্পন্ন করতে হয়। এখানেও স্বামীর মঙ্গল কামনা ও দীর্ঘায়ূ কামনা করেন স্ত্রীরা। এই ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে গর্ব অনুভব করেন মেয়েরা। বাংলায় এই ব্রত পালনের চল ধীরে ধীরে ঢুকতে শুরুও করে দিয়েছে।
ফিরে যাই ভাইফোঁটা প্রসঙ্গে। অনেকে ভাইফোঁটা নাম হলেও বিষয়টিকে লঘু করতে বলেন, এই সামাজিক উৎসব আসলে ভাইবোনের দুজনেরই মঙ্গল কামনায় উৎসব। মেয়েরা যেমন ফোঁটা দেন, বড় ভাইয়েরা তেমন আশীর্বাদ করেন। ছোট ভাইরা কি করেন? দিদিকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেন। এই আবেগীয় কথায় আসলে পুরুষতান্ত্রিক ধারা তাঁরা নিরাপদ করেন। বিবাহ প্রসঙ্গে গ্রন্থে সুকুমারী ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, আমরা শাস্ত্রের দোহাই পাড়ি তখনই, যখন সে শাস্ত্র আমাদের অভীষ্টের অনুকূল। প্রতিকূল হলে বেমালুম চেপে যাই সে শাস্ত্র।,,,,,,রবীন্দ্রনাথ নারীর মূল্যায়ন সম্পর্কে লিখেছেন, ,,,,,,,, তার ( নারীর) বুদ্ধি, তার সংস্কার, তার আচরণ নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার দ্বারা বহু যুগ থেকে প্রভাবান্বিত। তার শিক্ষা, তার বিশ্বাস বাহিরের বৃহৎ অভিজ্ঞতার মধ্যে সত্যতা লাভ করবার সুযোগ পাইনি। এইজন্য নির্বিচারে সকল অপদেবতাকেই সে অমূলক ভয় ও অযোগ্য অর্থ দিয়ে আসছে। সমগ্র দেশ জুড়ে যদি দেখতে পাই তবে দেখা যাবে এই মোহমুগ্ধতার ক্ষতি কত সর্বনেশে, এর বিপুল ভার বহন করে উন্নতির দুর্গম পথে এগিয়ে চলা কত দুঃসাধ্য।,,,,,,চিত্তের বন্দিদশা এমনি করে দেশে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে এবং প্রতিদিন তার ভিত্তি হয়ে উঠেছে।( প্রবন্ধ নারী, রবীন্দ্র রচনাবলী,১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬২১)
নারী তাঁর অস্তিত্ব রক্ষায় নিজের অধিকারটুকুও পায়নি ধর্মীয় শাস্ত্রে। সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখছেন, বারবার বলা হয়েছে, যে নারীর সভায় যাওয়ার অধিকার নেই ( মৈত্রায়ণী সংহিতা ৪/৭/৪; কোনো শিক্ষা পাওয়ার ধন অর্জন বা স্বাধীনভাবে ভোগ করার, এমনকি নিজের দেহটিকেও অবাঞ্ছিত সম্ভোগ থেকে রক্ষা করবারও অধিকার তার নেই।( মৈত্রায়ণী সংহিতা ৩/৬/৩;৪/৬/৭;৩/৭/৪;১০/১০/১১; তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২: ঐতেরেয় ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, পুত্র হলো সর্বোচ্চ স্বর্গের প্রদীপ আর কন্যা। হল দুঃখের। কারণ। ( ঋকবেদ: ১০/৩৯/১৪)
তবে প্রথা মেনে আজও পুরুষের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা করে ভাইফোঁটা পালিত হচ্ছে নিষ্ঠা ভরে। বিখ্যাত সেই ছড়া। যমুনা দেয়, ভাই যমকে ফোঁটা, আমি দেই আমার ভাই/ দাদাকে ফোঁটা। অর্থাৎ যম ও যমুনা এখানে দুই প্রধান চরিত্র। কে এই যম? কে যমুনা? পুরাণ মতে, যম দক্ষিণ দিকের দিকপাল। সূর্যের ঔরসে ও সংজ্ঞার গর্ভে জন্ম। বৈবস্বত মনুর ভাই। বীর্য বমনকালে সূর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে সংজ্ঞা তাঁর ছায়াকে স্বামী সূর্যের কাছে সঁপে পালিয়ে বাঁচেন। যথা সময়ে যমের জন্ম হয়। ছায়া সন্তান পালনে ছিলেন অমনোযোগী। যম তাই ধাত্রী মাকে পদাঘাত করেন। ছায়াও পাল্টা যমকে অভিশাপ দেন, যে পা দিয়ে যম মাতৃসমা নারীকে আঘাত করেছেন সেই পা ক্ষত ও কীটযুক্ত হোক। তাই হলো। পিতা সূর্য পুত্র যমের অবস্থা দেখে ক্ষতস্থানের পুঁজ ও কীট ভক্ষণের জন্য একটি কুকুর দেন। সেই চিকিৎসায় যম সুস্থ হন। কিন্তু পা দুটি হয়ে যায় দুর্বল। প্রতিবন্ধী বলা যায়। ফলে মহিষের মত শক্তিশালী জীবকে বাহন করেন। কিন্তু বিয়ের পাত্রী পেতে সমস্যা হয় নি। তাও আবার একজন নয়। দক্ষ রাজের ৪০ টি কন্যারব১৩ জনকে বিয়ে করেন। বাকি ২৭ জনের বিয়ে হয় চন্দ্রের সঙ্গে। বেশ কিছু সন্তানও হয়।
যমপুরীর নাম সংযমনী। নারী অবমাননা করলেও যম সবচেয়ে পূণ্যবান। মানুষের জীবনে শান্তি দেন। তাই আরেক নাম শমন। জীবনে অন্ত আনেন। তাই আরেক নাম অন্তক। যমের দেহের রং সবুজ। রক্তবর্ণ পোশাক। দুই অনুচর। মহা চন্দ ও কালপুরুষ। পুরাণ মতে, পৃথিবী থেকে যমলোকের দূরত্ব ৮৬০০০ যোজন। ঋকবেদে যমকে কিন্তু দেবতা মানা হয় নি।বলা হয়েছে দেব সহচর। যমের বোন যমুনা। সূর্যের যমজ সন্তান। ঋকবেদের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তের চৌদ্দটি শ্লোকে আছে এক নির্জন দ্বীপে যমের কাছে সহবাস প্রার্থনা করছেন যম ভগ্নী যমুনা। তিনি বলছেন, বিস্তৃত সমুদ্র দ্বীপে ভ্রাতা তোমার সঙ্গে সহবাস ইচ্ছা প্রকাশ করছি। কিন্তু যম বলেন, এটা অজাচার। অর্থাৎ অজ মানে ছাগল। বুদ্ধিহীন, নীতিহীন ছাগলের কাজ মানুষের করা সাজে না।যমুনা পাল্টা জবাব, বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা মাতৃগর্ভেই তাঁদের মিলনের সূচনা করেছেন। গর্ভে যদি একত্রে শয়ন করা যায়, তো গর্ভের বাইরে সম্ভব নয় কেন? তবু নাকি যম রাজি না হওয়ায় ক্রুদ্ধ যমুনা চলে যান সেই স্থান থেকে। পরে ফিরে এসে দেখেন বৃক্ষতলে যম শায়িত। দেহে প্রাণ নেই। যমের কোনো কাহিনীতে ভাই ফোঁটার কোনো প্রসঙ্গ নেই।
কিন্তু ভাষ্যকরেরা দাম্পত্যের দুই চরিত্র পুরুষ ও নারীকে বলেছেন যম ও যমী। একান্তই যা স্বামী স্ত্রী। বৈদিক শব্দকোষ পাণিনিও এই কথা স্বীকার করেছেন। আবার অন্য কিছু শাস্ত্রে যম ও যমীকে বলা হয়েছে আগুন আর পৃথিবী। বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক শাখা ব্রজসত্ত্ব। সেখানে যৌথ মূর্তি যম ও যমীকে আলিঙ্গন রত অবস্থায় দুজনকে চুম্বনরত দেখানো হয়েছে। যম দেবতা নন, আগেই বলেছি। মৃত্যুর পর যম হলেন দিকপাল। নরকের রাজা। যমের বিরহে যমুনা কাঁদতে কাঁদতে নদীতে পরিণত হন। এরপর নাকি কৃষ্ণ অগ্রজ বলরামের জেদে বলরামের স্ত্রী হতে বাধ্য হন যমুনা। ইতিমধ্যেই যম মনুষ্য জন্ম পরিত্যাগ করে দেবতা নরকের রাজা হয়েছেন।যমুনার আমন্ত্রণে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় আসেন বোনের শ্বশুরবাড়ি। সেখানে ভাইকে বরণ করেন বোন যমুনা। প্রশ্ন উঠতে পারে, সুভদ্রা অর্জুনের মাসী। কৃষ্ণ মামা। কেননা কুন্তীর ভাই কৃষ্ণ। কৃষ্ণ কিন্ত সুভদ্রার ফোঁটা নিয়েছেন তেমন তথ্য নেই। পুরীর জগন্নাথ যে সুভদ্রার কাছে ফোঁটা নেন তেমন কথাও শোনা যায় না। যম ও যমুনা যেহেতু হিন্দু মতে পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী তাই ভাইফোঁটার লৌকিক উৎসবে ধর্ম এসে জুড়ে যায়।
তবে শাস্ত্রে ভাই বোনের সহবাস সম্পর্ক যে নিষিদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। পুরাণে ব্রহ্ম কন্যাকে ব্রহ্মা পুত্র দক্ষের বিয়ের কথা আছে। পুরাণে পূষণ- অচ্ছোদা, অমাবসু, পুরু – কুৎসা ও নর্মদা, বিপ্রচিতি ও সিংহিকা, নহুষ – বিরজা, শত্রু – ঊষানস, অংশুমত ও যশোদা, দশরথ – কৌশল্যা ভাই বোন দাম্পত্যের কথা আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে ও অর্ধম্যাধী ভাষায় জৈন সাহিত্যেও ভাই বোনের বিয়ের কথা আছে। রামায়ণে রামের এক দিদি ছিলেন, শান্তা যাঁর নাম। রামকে তিনি ভাইফোঁটা দিয়েছেন এমন তথ্য নেই। মহাভারতে দ্রৌপদীর সবই পুত্র। সুতরাং সেখানেও ভাইফোঁটার গল্প নেই। দুর্গার চার পুত্র কন্যা হিসেবে যাঁদের পেয়েছি তাঁদেরও ভাইফোঁটার কোনো কাহিনী পুরাণে নেই। তবু ভাইফোঁটা শুধু বাংলায় নয়, দেশ জুড়েই পালিত হয়। মণিপুরে বলে হিয়াং সেই। এই তিথিতে বিবাহিত নারীরা আসেন বাপের বাড়ি। উত্তরভারতে ভাই দুজা। নেপালে ভাইটিকা। গুজরাটে ভাইবিজ। অন্ধ্র প্রদেশে চিলেলা পাংডাগা । শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় এই লৌকিক উৎসবকে শৃঙ্খলিত করার প্রয়াস থাকলেও তেমন প্রভাব বিস্তার করা যায়নি, বিভিন্ন শাস্ত্রকারের বিপরীত ব্যাখ্যার জন্য ,একথা বলাই যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এক বড় ঐতিহ্য ভাইফোঁটা।
Be First to Comment