জন্মদিনে স্মরণঃ নাজিম হিকমত
বাবলু ভট্টাচার্য : বিপ্লবী কবিতা লিখে দেশে দেশে যারা গণমানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন, নাজিম হিকমত তাদের অন্যতম।
জেলখানার কবি তিনি। সারাটা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য লড়েছেন। জ্বালাময়ী সব কবিতা লিখেছেন। আন্দোলন করেছেন। মানুষের অধিকার আদায় আর শ্রেণি-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে।
নাজিম হিকমত শুধু তুরস্কের কবি নন, তিনি পৃথিবীর কবি। সমস্ত শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কবি। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে, নানা ভাষায়। বাংলা ভাষায়ও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে নাজিম হিকমতের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। কবিতা ভক্তদের অসম্ভব প্রিয় তিনি। তার ‘জেলখানার চিঠি’ কবিতাটি পড়েননি বা শোনেননি এমন বাঙালি খুজে পাওয়া যাবে না। প্রায় সব আবৃত্তিকারই তার কবিতা আবৃত্তি করার জন্য রীতিমত মুখিয়ে থাকেন।

তুরস্কের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে নাজিম হিকমতের জন্ম। অল্প বয়সেই কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র সতের বছর বয়সে তার লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মিত্রবাহিনী অধ্যুষিত তুরস্ক ছেড়ে মস্কো চলে যান তিনি। এ সময়ে রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। হিকমত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তার কবিতা আরো জোরালো ও প্রতিবাদী হয়ে উঠতে থাকে।
১৯২৪ সালে তুরস্কের স্বাধীনতার পর তিনি ফিরে আসেন। একটি বামপন্থী পত্রিকায় কাজ করার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। কিন্তু হিকমত মস্কোয় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং সেখানে বসেই কবিতা এবং নাটক লিখতে থাকেন। ১৯২৮ সালের এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কারণে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন কবি। কমিউনিস্ট পার্টি ততদিনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণই সাদা পোশাকের পুলিশের লোকজন তাকে নজরদারিতে রাখতো।

পরের দশ বছরের পাঁচ বছরই তিনি নানা ধরনের বিচিত্র সব হাস্যকর অপরাধের অভিযোগে জেলখানায় কাটান। কিন্তু এই দশ বছরেই তিনি সুদীর্ঘ কবিতাসমৃদ্ধ চারটি বইসহ সর্বমোট ৯টি কবিতার বই প্রকাশ করেন। এই সমস্ত কবিতা তুরস্কের কবিতায় বিপ্লব সাধন করে। তুরস্কের প্রধানতম কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান তিনি।
১৯৩৮ সালে তুরস্কের সামরিকবাহিনীকে বিপ্লবে উস্কানি দেবার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাকে। তার অপরাধ ছিল তার দীর্ঘ কবিতাগুলো মিলিটারি ক্যাডেটরা পড়ছে এবং এতে করে তাদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জন্ম নিচ্ছে। ২৮ বছরের জেল সাজা দেয়া হয় তাকে।
১৯৪৯ সালে পাবলো নেরুদা, পল রবসন এবং জা পল সার্ত্রে প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল হিকমতের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা। ১৯৫০ সালে পাবলো নেরুদার সাথে যৌথভাবে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার লাভ করেন হিকমত। এই বছরেই আঠারো দিনের আমরণ অনশনে যান তিনি। তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসায় মুক্তি পান ঠিকই, কিন্তু তার যন্ত্রণার অবসান ঘটে না।
দুই দুইবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। পঞ্চাশ বছর বয়সে রাশিয়ান সীমান্তে সামরিক দায়িত্ব পালন করানোর চেষ্টা করা হয় তাকে দিয়ে। এইসব যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ছোট্ট একটা মোটর বোটে করে বসফরাস পাড়ি দিয়ে বুলগেরিয়া হয়ে রাশিয়াতে পালিয়ে যান তিনি। পরের বছরই তুরস্ক সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।
১৯৬৩ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান কবি।
ইতিহাসের কী চরম লীলাখেলা। পঞ্চাশ বছর আগে যাকে বিশ্বাসঘাতক বলে রায় দিয়ে নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল তুরস্ক সরকার, সেই তাকেই আবার সসম্মানে মরণোত্তর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে ধন্য হয়েছে তুরস্ক সরকার।

২০০০ সালে পাঁচ লাখ তুর্কি নাগরিক সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল নাজিম হিকমতের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য এবং তার দেহাবশেষ মস্কো থেকে তুরস্কে ফিরিয়ে আনার জন্য। তখন সে আবেদনে সাড়া দেয়া ছাড়া তুরস্ক সরকারের কিছু করারও ছিল না।
নাজিম হিকমত ১৯০২ সালের আজকের দিনে (১৫ জানু) তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন।


Be First to Comment