ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫। শরৎকালের ভোরবেলা। কাশফুলে ঢাকা নদীর ধারে গ্রামের পথ জেগে উঠেছে শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে। পাড়ার মহাশয় ঠাকুর মশাই সাদা ধুতি পরে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে। আজ মহাসপ্তমী। গ্রামের সকলে অপেক্ষা করছে এক বিশেষ মুহূর্তের জন্য—নবপত্রিকা স্নান।
কলাগাছের কচি পাতা জলে দোল খাচ্ছে। গ্রাম্য নারীরা একজোড়া বেলপাতা হাতে নিয়ে গঙ্গার ধারে গেয়ে উঠল
“রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ্ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িম্বৌ।
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।। ”
নয়টি গাছের সমষ্টি একত্রে বাঁধা হচ্ছে অপরাজিতা লতার ফিতে দিয়ে। কলাগাছকে সাজানো হচ্ছে যেন এক নববধূ—লালপাড় সাদা শাড়ি, ঘোমটা আর সিঁদুরের টিপ। গ্রামের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে উঠল—“কলাবউ! কলাবউ আসছে!”
কিন্তু এই কলাবউ কে? কার বউ? ঠাকুর মশাই ধীরস্বরে বলতে লাগলেন—
“শোনো, কলাবউ গণেশের স্ত্রী নয়। এটি দেবী দুর্গারই প্রকৃতি-শক্তির রূপ। নয়টি গাছ একত্রে হলো দুর্গার নয় রূপ—ব্রাহ্মাণী, কালিকা, উমা, কার্তিকী, শিবা, রক্তদন্তিকা, শোকরহিতা, চামুণ্ডা, আর লক্ষ্মী।”
তিনি আরও বললেন—
“মার্কণ্ডেয় পুরাণ বা কালিকাপুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ স্পষ্ট নেই, তবে ‘পত্রিকাপূজা’র বিধান আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্র নিজে বলেছিলেন—
‘বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।’
অর্থাৎ, এই আচার শাস্ত্র, লোকাচার আর গ্রামীণ সাহিত্য সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে।”
গ্রামের প্রবীণ দাদীমা বলেন—
“আমাদের ঠাকুরমা বলতেন, দেবী একসময় শাকম্ভরী রূপে শস্যের দেবী ছিলেন। তাই ধান, হলুদ, ডালিম, কচু—সব শস্য আর উদ্ভিদই তাঁর পূজায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতিকে মা রূপে দেখাই নবপত্রিকার মূল তত্ত্ব।”
যুবকরা শঙ্খ বাজাতে বাজাতে কলাবউকে স্নান করাল। সূর্য তখনও ওঠেনি। বলা হয়, এই সময় নদীর জল পবিত্রতম। স্নানের পর কলাবউকে দেবী দুর্গার ডানদিকে বসানো হলো। মন্দিরে ধূপধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। পূজারি মন্ত্র পড়লেন—
“নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ।”
সেই মুহূর্তে গ্রাম যেন প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল। ধানখেতের দোলা, বেলগাছের ছায়া, কচুপাতার ঝিলিক—সব যেন বলছে, “আমরাই মা, আমরাই দেবী।”
গল্পের শেষে গ্রামের এক কিশোরী, স্নিগ্ধা, তার মাকে জিজ্ঞেস করে—
“মা, নবপত্রিকা কি সত্যিই বউ?”
মা হেসে উত্তর দেন—
“না রে, ও বউ নয়। ও তো মা। আমাদের মাটি, আমাদের ফসল, আমাদের প্রকৃতি—সব মিলেই দেবী দুর্গার রূপে এসেছেন। তাই তো আমরা তাঁকে সিঁদুর দিই, বধূ সাজাই—কারণ প্রকৃতি সর্বদা নতুন, চিরকুমারী, আবার চিরমঙ্গলময়ী মা।”
শঙ্খধ্বনি বাজতে থাকে। কাশফুল দুলতে থাকে। আর নবপত্রিকার মাধ্যমে দুর্গাপূজার মহাযজ্ঞ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়—শাস্ত্র, সাহিত্য আর লোকজ প্রথার মিলনমঞ্চে।
Be First to Comment