বেলুড় মঠে ক্রিসমাস ইভের প্রার্থনা
“দীর্ঘ চোদ্দ বছর আমি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্ট, বৌদ্ধ সব ভাবের সাধনা করেছি। আমি জেনেছি সব ধর্মের মূল সেই ঈশ্বর লাভ।”
[ শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত ]
বাবলু ভট্টাচার্য : সন্ধ্যে হয়েছে। ঠাকুরের মন্দিরে আরতি সবে শেষ হয়েছে। বিরাট হল ভর্তি ভক্তরা বসে আছেন। সামনে শ্রী শ্রী ঠাকুরের মূর্তি আর বাঁ দিকে মা মেরী আর যীশুর ছবি সিংহাসনে বসিয়ে ফুল মালা দিয়ে অপূর্ব ভাবে সাজানো।
দু’পাশে মোমদানি, এক উষ্ণ অথচ মৃদু আলোয় ভরে আছে চারপাশ। পশ্চিমে বয়ে চলেছে গঙ্গা, নিস্তব্ধ নাটমন্দিরে একে একে সাধু সন্ন্যাসীরা এসে বসতে শুরু করলেন।
দু’জন মহারাজ নিয়ে এলেন ভোগ, যা আজ যীশু আর মা মেরী কে নিবেদন করা হবে। তিল ধারণের স্থান নেই আর গোটা নাটমন্দিরে। মোমের নরম আলো, ধূপের হালকা মিষ্টি গন্ধে ভরে যাচ্ছে চারিদিক, মোমের শিখা কাঁপছে, পুরনো বিশাল কারুকার্য করা থামের ছায়া, আগেরকার দিনের পিতলের কাজ করা ঝাড়বাতি… সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ।
পূজারী মহারাজ এলেন। সমবেত সাধু সন্ন্যাসীরা শুরু করলেন ক্রিসমাস ক্যারল। ছোটবেলায় যা স্কুলে শুনেছি আমরা, আজ এতদিন পর আবার সেই চেনা সুর, সেই চেনা অনুভূতি।
মহারাজেরা যীশুর জীবনী থেকে কিছু অংশ পাঠ করলেন, আর তাঁর সাথে ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবনের কিছু ঘটনা যা হু-বহু মিলে যায়।
ঠাকুরের তখন ৩৮ বছর বয়েস, ঠাকুরের একবার খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে জানার প্রবল ইচ্ছে জাগে। একবার তিনি যদু মল্লিকের বাগানবাড়িতে যীশুর এক ছবি দেখেন আর অনুভব করেন এক দিব্য জ্যোতি তাঁর দেহে প্রবেশ করছে।
এই ঘটনার পর থেকে তাঁর আচার আচরণ সব বদলে যায়। এমনকি তিনি দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মন্দিরে মা-কে প্রণাম করতেও যেতেন না। এই ভাব তিনদিন ছিল।
তিনদিন এভাবে চলার পর একদিন তিনি পঞ্চবটীতে পায়চারি করছেন আপন মনে, হঠাৎ দেখলেন এক অপূর্ব দেব মানব- গৌরবর্ণ তাঁর চোখে চোখ রেখে তাঁরি দিকে এগিয়ে আসছেন। বাহ্য জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে তাঁর ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল– ‘ঈশা মসি! পরম পুত্র ঈশা মহাযোগী, যিনি তাঁর জগতের মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন- সেই ঈশা মসি!’ এরপর সেই অদ্ভুত দেবমানব তাঁকে আলিঙ্গন করে তাঁরই দেহে মিলিয়ে যান।
এই ঘটনার অনেক বছর পর ভক্তদের সাথে কথার সময় ঠাকুরের দিব্য দর্শন নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ঠাকুর বলেন- ‘তোমরা সব ইয়ং বেঙ্গল, বাইবেল পড়েছ, তা বল দেখি ঋষি কৃষ্ণ (ঠাকুর যীশুকে এই নামে ডাকতেন) কেমন দেখতে ছিলেন?’
তখন ভক্তরা বললেন– ‘যীশু কেমন দেখতে ছিলেন তাঁর উল্লেখ বাইবেল এ পাওয়া যায় না, তবে তিনি ইহুদী ছিলেন। তাঁর গাত্র বর্ণ গৌর ছিল এবং চোখ নাক টিকলো টানা টানা ছিল নিশ্চয়’। একথা শোনা মাত্র ঠাকুর বলেছিলেন– ‘আমি কিন্তু বাপু দেখলুম তাঁর নাকের অগ্রভাগ ঈষৎ চ্যাপ্টা’।
ঠাকুরের মহাসমাধির অনেক পরে তিনটি বিশ্বস্ত সুত্রে যীশু’কে কেমন দেখতে ছিল তা জানা যায়, তাঁর মধ্যে একটি ছিল ঠাকুরের দেখা সেই ঈষৎ চ্যাপ্টা নাক।
Be First to Comment