Press "Enter" to skip to content

দীপাবলির আতসবাজি কি কোভিড রোগীদের জীবনে চূড়ান্ত বিপর্যয় ডেকে আনবে?……

Spread the love


এবছর বাজিকে আমাদের পুরোপুরি কোয়ারেন্টাইন এ পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। — সুভাষ দত্ত (পরিবেশকর্মী)।

সঙ্গীতা চৌধুরী : কলকাতা, ৫, নভেম্বর, ২০২০।
বর্তমান অতিমারির সময়ে করোনার মতো শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ও বাজি – দূষণের যৌথ আক্রমণে এ বার দীপাবলির সময় পরিস্থিতি যে সঙ্কটজনক হতে চলেছে, তা নিয়ে কোন সংশয় নেই বলেই জানাচ্ছেন পরিবেশকর্মী ও চিকিৎসকেরা। উৎসবের সময় বাজি থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ যে শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করে তা এখন সকলেই জানেন। তাছাড়া দূষিত বায়ুর জন্য এমনিতেই ফুসফুসের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। ফলে দুর্বল ফুসফুস, বাজির দূষণ ও করোনা সংক্রমণ – এই তিনটির কারনে এবছর দীপাবলির সময় কোভিড পরিস্থিতি আরও মারাত্মক বলে সর্তক করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারনে বিশ্বে প্রায় ৭০লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা গেছে। কিন্তু এই বার্ষিক বায়ু দূষণের সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে করোনা সংক্রমণ, যার লক্ষ্যও বায়ুদূষণের মতোই ফুসফুসের ক্ষতি। এর ওপর বাজির দূষণ ঘটলে পরিস্থিতি একদম আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাবে বলে এ বছর আলোর উৎসবে জনসাধারণকে সংযম দেখানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। দুর্গাপুজোর মতো দীপাবলিতে বাজির ব‍্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি নিয়ে সরব হয়েছেন চিকিৎসক সংগঠনগুলি ও পরিবেশ কর্মীরা। ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের সম্মানীয় বিচারপতিগণ বাজি বিক্রয়ের উপর কালীপুজো থেকে ছটপুজো পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছেন। এখানে বিশিষ্ট চিকিৎসকগণ ও পরিবেশকর্মীর মতামত তুলে ধরা হলো।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মানিক ঘোষ জানালেন, ” এতদিন ধরে শব্দ বাজি আইন করে বন্ধ করার চেষ্টা চলছে, কিন্তু এবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে কোন ধরনের বাজি পোড়ানোই আর ঠিক নয়। বাজির পোড়ানোর ফলে দূষণ যে পরিমানে বেড়ে যাবে তাতে কোভিড তো বাড়বেই , তার সঙ্গে যাদের ফুসফুসের সমস্যা আছে ,যেমন – হাঁপানি বা সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ) তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে দূষণ যখন বাড়বে তখন করোনা ভাইরাস কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে আর সেটা তখন এরোসলের মধ্যে এয়ারে ঘুরতে থাকবে। সে সময় একজন সিওপিডি পেশেন্ট যদি নিঃশ্বাস নেয় সেটা তার নাসিকা পথে ফুসফুসে প্রবেশ করে। তাই আমার মতে, এবারে সাধারণ মানুষের উচিত যে কোন রকমের বাজি থেকেই দূরে থাকা। বাজি সাধারনতঃ অল্প বয়সীরাই পোড়ায় , কিন্তু তাদের সচেতন থাকতে হবে যে তাদের আনন্দের কারনে যেন তাদেরই পরিবারের বাবা – মা বা বাড়ির ঠাকুরদা – ঠাকুমারা অসুস্থ না হয়ে পড়েন। শীতকালে বায়ু দূষণের ফলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেক্ষেত্রে আমাদের তো কিছু করার নেই , কিন্তু দীপাবলিতে বাজি পোড়ানোটা পুরোপুরি আমাদের হাতে। তাই সকলের কাছে আমার অনুরোধ এ বছরটা বাজি ব‍্যবহার বন্ধ করুন , তাহলে আমাদের এটা মনে হবে যে সংক্রমণ রোধের অন্তত একটা চেষ্টা করেছিলাম। “

তবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ অরিন্দম বিশ্বাস দীপাবলির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন জনসমাগমকে। তিনি বলেন, “কোভিড হলো একপ্রকার ভাইরাস, এর সংক্রমণ হচ্ছে একটু অন‍্যভাবে। এক্ষেত্রে একজন মানুষ যখন কোন সংক্রমিত মানুষের সান্নিধ্যে চলে আসে তখন সেই মানুষটি যদি কাশে বা হাঁচি দেয় , সেই জলকনার মাধ্যমেই অন্যজন সংক্রমিত হয়। এই জলকনার মধ্যেই থাকে ভাইরাসটি। কিন্ত দীপাবলিটা অন‍্যরকম। এখানে রঙমশাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বাজি পোড়ানো হয়। এতে একদিকে যেমন শব্দ দূষণ হয় তেমনি অন‍্যদিকে যে গ‍্যাসগুলি উৎপন্ন হচ্ছে সেগুলি যদি কোন মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে দুধরনের সমস্যা হতে পারে। প্রথমতঃ হলো অ্যালার্জির সমস্যা তাতে সর্দি -কাশি হতে পারে , কিছুক্ষনের জন্য একটা শ্বাসকষ্ট হতে পারে। দ্বিতীয়তঃ যারা ফুসফুস জনিত রোগে ভোগেন , তাদের শরীরে যদি এই গ‍্যাস প্রবেশ করে তখন কিন্তু একটা শ্বাসকষ্ট তৈরি হতে পারে। যারা হাঁপানির রোগী তাদের ও কষ্ট বেড়ে যাবে। আর শব্দ বাজি হার্টের রোগীদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে কোভিড আর দীপাবলিকে একই সূত্রে বাঁধা যায় জনসমাগম দিয়ে। কারন এই বাজি পোড়ানোর সময় অনেক মানুষ একত্রিত হয়ে এই উৎসবের উৎযাপন করে, সেক্ষেত্রে কতজন মাস্ক পড়বে আর বিধিনিষেধ মানবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দশজন লোক যদি একত্রিত হয় তাতে চোদ্দো শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে , সে সম্ভাবনার কথা মার্কিন সংস্থার একটি রিপোর্টে আছে। এ সবকিছুই আমাদের ভাবনা – চিন্তা করতে হবে । এই বছরটা একটা ব‍্যাতিক্রমী বছর। তাই এবারে যদি বাজি পোড়াতেই হয় তাহলে জনসমাগম এড়িয়ে কোন নিরালা স্থানে গিয়ে করবো। এই অঙ্গীকার খুব দৃঢ়তার সঙ্গে করতে না পারলে সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাবে। চিকিৎসক হিসাবে আমাদের চিন্তার জায়গাটা হল, সংক্রমণ বাড়লে চিকিৎসাকেন্দ্র ও সেবা দান করার মতো চিকিৎসক এবং নার্স – এর সংখ্যাটা কিন্তু খুব বেশি নয়। তখন চিকিৎসা পাওয়াটা মানুষের ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের মননশীলতার পরিচয় দেখাতে হবে। তা না হলে আবার একটা সংক্রমণের ঢেউ উঠবে। তাই এই মুহূর্তে আমাদের সচেতন নাগরিকতার পরিচয় অবশ্যই কাম‍্য। “

‘এনভায়রনমেন্ট এন্ড চাইল্ড হেলথ ডু অফ ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক ‘-এর চিকিৎসক তন্ময় মৈত্র বললেন , ” ‘ ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমী অফ প্রেডিয়াট্রিক ‘চাইল্ড স্পেশালিস্ট যে সংস্থা আছে সারা ভারতব‍্যাপী, সেখানে আমাদের কতগুলি সাব স্পেশালিটি চ‍্যাপ্টার আছে। তারমধ্যে এনভায়রনমেন্ট এন্ড চাইল্ড হেলথ বলে একটি চ‍্যাপ্টার আছে। আমাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে দূষণ নিয়ে বিশেষ ভাবে কাজ করা। কিছুদিন আগেই আমাদের একটা ইন্টারন‍্যাশানাল ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে বিশ্বের ২৬ টা দেশ অংশগ্রহণ করে। তার মূল বিষয়ই ছিল দূষণ এবং কোভিড রোগীদের সমস্যা। দূষণের সমস্যা বহু কাল ধরেই আছে , বিশেষতঃ শীতকালে তা মাত্রাধিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। পরিবেশবিদরা এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন এবং আমরাও এ বিষয়ে সচেতন করি, কতটুকু কাজ হয় সেটা পরের ব‍্যাপার। তবে কিছুটা তো নিশ্চয়ই হয়েছে। আমরা প্রশাসনের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করি। তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের সচেতনতা। কারণ এ বছর দূষণের সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা সংক্রমণের মতো অতিমারি, তাই আমাদের আরও বেশি সচেতনতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজি পোড়ানোর কারনে যে বিষাক্ত গ‍্যাস বাতাসে ছড়িয়ে যায় , তাতে যে করোনা রোগী হয়তো একটু চেষ্টা করলে বেঁচে যেত সে ও মৃত্যুর কবলে পতিত হবে। তাই সচেতনতাটা সর্বস্তরে যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাতে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হতে পারে। আর প্রশাসনকে ও বাজি পোড়ানো থেকে সাধারণ মানুষকে বিরত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। “

বায়ু দূষণ ও কোভিড পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন , “দূষণ রোধ করা নিয়ে অনেক দিন কাজ করছি , তাতে দেখেছি যে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে প্রায় মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাতাস খুব ভারি থাকে। এটা প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে। সেই সময় দূষণের মাত্রাটা সাঙ্ঘাতিক রকম বেড়ে যায় । দূষণের মাত্রাটা বেশি থাকার জন্য শীতকালে মানুষ বেশি অসুখে ভোগে। এই সময় শারীরিক দাবি গুলো খুব বেশি হয়, যেমন – ডায়াবেটিস পেশেন্ট , হার্টের পেশেন্ট , ফুসফুসের সমস্যা জনিত পেশেন্ট – এরকম কিছু পেশেন্টেদের সমস্যা বেড়ে যায়। এটা প্রতি বছরের একটা চিত্র। তবে বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবী যেখানে লড়ছে , আর শীতের দেশ থেকেই এই কোভিড – ১৯ -এর আর্বিভাব হয়েছে সেখানে শীতের সময় একটা বাড়তি ভয় থেকে যাচ্ছে।

পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত।

তাছাড়া বাতাসের মাত্রাধিক‍্য দূষণ থেকে ও কোভিড সংক্রমণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সব কারনে এ বছর অন্তত বাজিকে আমাদের পুরোপুরি কোয়ারান্টিনে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। এই নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার চিন্তা – ভাবনা চলছে। তবে এই ধরনের মামলা একমাত্র সুপ্রিম কোর্টেই হয়। সুপ্রিম কোর্টে বাজি সংক্রান্ত কিছু মামলা চলছে ও। বাজি থেকে যে দূষণ ছড়ায় সেটা মানুষের সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি করে । এবছর তার ওপর আবার কোভিডের প্রাদুর্ভাব। তাই বাজিকে এ বছরের জন্য একেবারে বর্জন করাটাই একমাত্র কাম‍্য।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অরুনাংশু চক্রবর্তীর মতে, ” কোভিড নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ভাবনা – চিন্তা আসছে । অনেক ব‍্যাপারে আবার আমরা কোভিড নিয়ে একটু দ্বিধাগ্রস্তও আছি , তবে একটা কথা খুব পরিস্কার যে কোভিড আর পাঁচটা ভাইরাস সংক্রমণের মতোই একটি ভাইরাসের সংক্রমণ। যদিও আমরা এখনও কোভিড সম্পর্কে একশো ভাগ সব কিছু জানি না। এটা একেবারে নতুন একটি সংক্রমণ , তাই এই সংক্রমণটি নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের মতামত আসছে । এই সংক্রমণের ফলে রোগীর ফুসফুস ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবে দীপাবলির সময় আতসবাজি পোড়ানোর ফলে তাতে কার্বন – ডাই অক্সাইড , কার্বন – মনোক্সাইড , সালফার – ডাই অক্সাইড ইত্যাদি আরও নানা দূষিত জিনিস বাতাসে ছড়িয়ে যায় । যারা কোন রকম ফুসফুসের সমস্যায় ভোগেন তারা ওই দূষিত বায়ু দ্বারা মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হন। এমনিতেই শীতকালে আমাদের দেশে স্মগ খুব বেশি থাকে , সেগুলি নিচের দিকে নেমে এসে এরোসল হিসাবে থাকে । আর ভাইরাসগুলো এই সময়ই তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, এরপর তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে রোগীর শরীরে দ্রুত প্রবেশ করে। এইভাবে বাতাস বাহিত হয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। আর যারা সংক্রমণে ভুগছেন তারা আরও সঙ্কটজনক স্থানে পৌঁছে যান। তাই এ বছর দীপাবলিতে সবরকম বাজির ওপরই প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা জারি অবশ্যই কাম‍্য।

“বহু দিন ধরেই আমরা কোভিড সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করে চলেছি। তা- ও কোভিড পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে কেউ জানেনা। আমরা এখনও সংক্রমণের মাঝ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছি , স্থলভাগের দেখা নেই। প্রশাসন থেকেও এখনও অবধি বাজি ব‍্যবহারের ওপর তেমন কোন রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। জনসাধারণের কাছে শুধু বাজি ব‍্যবহার না করার আবেদন জানানো হয়েছে। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত‍্যেককেই সে দায়িত্ব নিতে হবে।

ছবি – সংগৃহিত।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.