সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৭ মে ২০২২। আবার আত্মহত্যা। গত একসপ্তাহে পর পর আত্মহত্যা করলেন মডেল অভিনেত্রী মঞ্জুষা নিয়োগী। প্রথমে পল্লবী দে। তারপর তাঁর বান্ধবী বিদিশা দে মজুমদার। গতকাল রাত্রে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলেন মডেল অভিনেত্রী মঞ্জুষা নিয়োগী। তিনজনের আত্মহত্যার মূল কারণ হলো চূড়ান্ত হতাশা। এই হতাশা থেকে পরাজয় মেনে নেওয়া। সেখান থেকেই তিনকন্যা আত্মহত্যা করলেও তিনটি ঘটনার কিছু কিছু পার্থক্য আছে।
পল্লবীর ক্ষেত্রে কাজ করেছে দ্রুতগতির গ্ল্যামারে মোড়া জীবনের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা। একদিকে ক্যারিয়ার তৈরির লড়াই, অন্যদিকে যেহেতু এই পেশার সঙ্গে অনিশ্চিয়তা শব্দটি জড়িয়ে আছে তাই একজন পুরুষের প্রতি নির্ভরতাও পল্লবীর কাছে মনে হয়েছে। আজকের সমাজে ভার্জিন শব্দটা মূল্যহীন হয়ে গেছে। তাছাড়া অন্যের কাছের মানুষকে ছিনিয়ে আনার মধ্যেও একটা জয়ের আস্বাদ লুকিয়ে থাকে। তদন্ত চলছে। সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে জটিলতার পরতে পরতে যা রহস্য লুকিয়ে আছে তা ক্রমশ স্পষ্ট হবে।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটলো কলকাতার উপকন্ঠে দমদম নাগেরবাজারে। রামগড় এলাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন বিদিশা দে মজুমদার। তাঁর বাড়ি কিন্তু কাঁকিনাড়ায়। কলকাতা থেকে খুব বেশি দূর নয়। এই প্রতিবেদকের বন্ধু ছিলেন তাপস পাল। তাপস যখন দাদার কীর্তি ছবি করে পরিচিত মুখ, তখনও তিনি কলকাতা আসতেন চন্দননগর থেকে ট্রেনে। তখন বরং যাতায়াতের এত সুবিধে ছিল না । বাড়ি থেকে দমদমে এসে মেট্রো ধরে টালিগঞ্জ পৌঁছানো অনেক সহজ এখন। কিন্তু একটু টিভিতে মুখ দেখালেই ছেলে মেয়েরা নিজেদের গ্ল্যামার জগতের স্টার ভাবতে শুরু করে দেন। মিডিয়ার দৌলতে প্রচারও মেলে দ্রুত। সাবাই পেজ থ্রি এর সেলিব্রিটি হতে চান । জীবনযাত্রার মান এই সব এরা বাড়িয়ে নেন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা অভিনেত্রীদের মত। আজকাল আবার গ্ল্যামারের মোহে বড় সহায়ক হয়েছে মডেলিং। সেখানেও রয়েছে অনেক রহস্য। ইঁদুর দৌড়ে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ার পেছনে কাজ করে দ্রুত সাফল্যের ধারণা । সেখানে ব্যর্থতা এলেই জীবনের উপযোগিতা তাঁদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বিদিশার ক্ষেত্রে জানা গেছে, তিনি দমদমের বাড়ি ভাড়া পর্যন্ত দিতে পারছিলেন না। অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া দেওয়ার মত আর্থিকজোর ছিল না। এই পেশার লড়াইতে বিদিশা নেমেছিলেন পুরোটাই অনিশ্চিয়তা পুঁজি করে । ফলে পল্লবীর আত্মহত্যায় তিনি রিয়াক্ট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মহত্যা সঠিক সিদ্ধান্ত না বলে মন্তব্য করে নিজেই সে পথ বেছে নেওয়ার বলা যায়, অল্প বয়সে জীবন বোধ, নিজের যোগ্যতা সম্বন্ধে সম্যক বাস্তব ধারণা না থাকার ফল। পরিবার থেকে সঠিক তালিম না পাওয়া এবং তালিম পেয়েও না মানার ফল আজকের এই ঘটনা।
এই মুহূর্তে মঞ্জুষার আত্মহত্যা হতাশার কারণ হলেও আর্থিক সমস্যা ছিল না। বাড়ির অমতে একটু বেশি বয়সি ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ তিনি কিন্তু ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই করে নেন। বোঝা যায়, বাস্তব দুনিয়ায় নিজের কোনো ইচ্ছা পূর্ণ করতে আর্থিক জোর যে দরকার সেই বাস্তব বোধ মঞ্জুষার ছিল। স্বামীও তাঁর ক্যারিয়ার তৈরিতে বাধা দিয়েছেন এমন তথ্যও এখনও মেলেনি। তাহলে ? সামান্য তথ্য মিলেছে, কোনো বিষয় নিয়ে মঞ্জুষার স্বামী রামনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথাকাটি হয়। রামনাথ নাকি স্ত্রীর মডেলিং পছন্দ করতেন না। যতদূর জানা গেছে, ইদানিং কাজের ক্ষেত্রে অডিশনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন মঞ্জুষা। এই ব্যর্থতার কারণ যোগ্যতার প্রতিযোগিতায় তাঁর মেধা কম নাকি ইত্যাদি শর্তের সঙ্গে আপোষ না করা? সব তথ্যই যে সামনে আসবে এমন কোনো কথা নেই। কেননা এই তিন কন্যার অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে পারিবারিক বন্ধনের অভাব,অন্যদিকে বেলাগাম চাহিদা, দ্রুত সফল হওয়ার চাহিদা এসব স্বপ্নের ইচ্ছাপূরণ না হওয়াতে জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া। আসলে এসব পরিণত মানসিকতার অভাব।
না হলে অন্তত মঞ্জুষার বাড়ির লোক যখন শুনেছিলেন, মেয়ে মরতে চায় তখন তাঁরা সাবধান হননি কেন? নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, আমার জীবনের সাফল্য নয়, আমার ব্যর্থতাকে গুরুত্ব দাও। মার্ক টোয়েন বলেছেন, জেদ আর আত্মবিশ্বাসই একমাত্র সাফল্য এনে দেয়। সাফল্যের সঠিক সংজ্ঞা দক্ষতা। সেটা সম্পর্কে আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার।
Be First to Comment