শ্রীজিৎ চট্টরাজ /গোপাল দেবনাথ : কলকাতা, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী ল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন মায়াপুরের গৌরকিশোর দাস বাবাজি মহারাজের কাছে। প্রথম মঠ চৈতন্যদেবের জন্মস্থান মায়াপুরেই ১৯১৮ সালে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কলকাতায় চৈতন্য মহাপ্রভুর নামগান প্রচারের জন্য যখন তিনি আসার সিদ্ধান্ত নেন, দীক্ষা গুরু বলেন, কলির আস্তানা কলকাতা।
সেখানে পাপের আবহ। সেখানে যেয়ো না। উত্তরে শ্রী ল বলেছিলেন,আপনার আশীর্বাদ থাকলে কলকাতায় কলির পাপ আমাকে ছুঁতে পারবে না। তিনি কলকাতায় এসে উল্টোডাঙার এক ভাড়াবাড়িতে শুরু করেন চৈতন্যদেবের ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার এবং প্রসারের কাজ। পরবর্তী সময়ে কিছু ধনী অনুরাগীর আর্থিক আনুকূল্যে সাবেকি কলকাতার বাগবাজারে গড়ে ওঠে আজকের এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ। সেদিন যদি দীক্ষাগুরুর কথা শুনে শ্রী ল কলকাতায় না আসতেন, তাহলে বাংলার আধ্যাত্বিক পরিমণ্ডলে চৈতন্যের ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব এর এই ব্যাপ্তি বোধহয় ঘটতো না।
শ্রী ল ভক্তি সরস্বতী প্রভুপাদের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল বিমলাপ্রসাদ দত্ত। মাতা ভগবতীদেবী। পিতা কেদারনাথ দত্ত ওরফে ভক্তি বিনোদ ঠাকুর নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। পুত্রকে শৈশবেই বিভিন্ন পুজো পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। শ্রী ল ভক্তি সরস্বতী প্রভুপাদের জন্ম ১৮৭৪ সালে পুরীতে। আগামী ২০২৫ সালে হবে তাঁর সার্ধতম জন্মবার্ষিকী। সেই স্মরণীয় ক্ষণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিন বছর ধরে ওড়িশার পুরী সহ বিভিন্ন মঠ, কলকাতা, মুম্বাই চেন্নাইয়ের মঠ ও দেশের বিভিন্ন রাজ্যে যেখানেই মঠের শাখা আছে সেখানেও সংগঠিত হবে নানা অনুষ্ঠান। এছাড়াও লন্ডন, আমেরিকা ও জার্মানিতেও সেখানকার মঠের অগণিত ভক্ত ও সন্ন্যাসীরা পালন করবেন প্রতিষ্ঠাতার সার্ধতম জন্মজয়ন্তী।
এই উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠে সকালে আয়োজন করা হয় এক সাংবাদিক সম্মেলন। বক্তব্য রাখেন শ্রী পাদ ভক্তিনিষ্ঠ মধুসূদন মহারাজ, শ্রীমদ ভক্তিসুন্দরসন্ন্যাসী গোস্বামী ও মহারাজ শান্তনু পালোধী। সন্ন্যাসীরা জানান, মঠ প্রতিষ্ঠাতার তিনবছর ব্যাপী সার্ধতম জন্মজয়ন্তী উৎসবের সূচনা হবে প্রতিষ্ঠাতার জন্মস্থান পুরীতে আগামী ২০ফেব্রুয়ারি সকাল এগারোটায়। উৎসবের সূচনা করবেন দেশের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। রাষ্ট্রপতি প্রথমে যাবেন শ্রী ল র জন্মভিটায়। সেখানে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। থাকবেন ১০মিনিট। সেখান থেকে তিনি যাবেন জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি গুণ্ডিচা মন্দিরে। সেখানেই ওড়িশা শাখার উদ্যোগে হবে মূল অনুষ্ঠান। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ও ওড়িশার রাজ্যপাল সহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শ্রী ল র অনুগামীরা।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মঠের তরফে জানানো হয়, তিনবছর ব্যাপী অনুষ্ঠানে নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমা থাকবে। রাখা হবে বিশেষ প্রদর্শনী। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও পালিত হবে প্রতিষ্ঠাতার ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী। সিদ্ধান্ত হয়েছে, শ্রী ল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভূপাদের জন্মক্ষণে ডিজিট্যাল মাধ্যমের সাহায্যে বিশ্বব্যাপী ,যেখানেই সংগঠনের শাখা আছে, সেখানেই একই সময়ে মহা আরতির আয়োজন করা হবে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০২৪ সালে তিনবছর ব্যাপী জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটবে এই কলকাতায়। রাজ্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার যেন নামকরণ করা হয় শ্রী ল প্রভূপাদের নামে। করোনা সমস্যা কাটলেই কলকাতা পুরসভা এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বলে তাঁদের জানানো হয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে ২০১৯ সালে কলকাতার বাগবাজারে সংগঠনের প্রধান কার্যালয়ে গড়ে উঠেছে একটি বিশেষ জাদুঘর। যেখানে চৈতন্যদেবের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়াও আছে শ্রী ল প্রভূপাদের ব্যবহৃত সামগ্রীর সংগ্রহশালা। ২০১৯ সালে এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এখানে আছে চৈতন্যদেবের ব্যবহৃত সামগ্রী। আছে তাঁর হাতে লেখা তাল পাতার পুঁথি।
২০১৩ তে এই জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। ২০১৬ সালে পরিদর্শনে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সাংবাদিক সন্মেলনের শেষে এইদিন এই বিশালাকার সংগ্রহশালাটি আগ্রহী সাংবাদিকদের ঘুরিয়ে দেখান মিউজিয়ামের কিউরেটর প্রীতম বাগচি।
বাংলার অধ্যাত্বিক দুনিয়ায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠের কর্মযজ্ঞ ইতিমধ্যেই এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন শ্রী ল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভূপাদের অসংখ্য ভক্তবৃন্দ।
Be First to Comment