স্মরণ : তা রা শ ঙ্ক র ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য : টানা তিন বছর কিচ্ছু লিখলেন না। অথচ সাহিত্যিক হিসেবে তিনি তখন মধ্যগগনে।
পরে আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ‘‘লিখতে ইচ্ছে হয় না। লিখি না। লেখা ছেড়েই দিলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করলাম। বসে বসে ভাবি। আর কাঁদি। একলা কাঁদি। পূজার সময় কাঁদি। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে কাঁদি।’’
শাক্ত-পরিবারের ছেলে। বাড়ির বিশ্বাস, মা তারার দয়ায় তার জন্ম হয়েছে, তাই নাম রাখা হয়েছিল তারাশঙ্কর।
রক্তে আধ্যাত্মিকতা। মন অশান্ত, কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছেন না। কীসের অতৃপ্তি বুঝতে পারছেন না।
এরই মধ্যে রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমির মতো পুরস্কার পেলেন কিন্তু পুরস্কার পাবার আনন্দ কই? কিছুই যেন স্পর্শ করছে না। ছটফট করছে ভেতরটা।
কলকাতার রাস্তায় এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখা হয়ে গেল এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। সারাদিন সে সন্ন্যাসী আগুন ছুঁয়ে সাধনা করেন।
মনে ধরল সেই সাধুকে। জানলেন তার বাস কাশীতে। সংসার ছেড়ে দিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব নেবেন ঠিক করে যেদিন আবার দেখা করতে গেলেন শুনলেন সন্ন্যাসী ফিরে গেছেন।
তাঁর সন্ধানে তারাশঙ্করও রওনা দিলেন কাশী। দেখা হয়ে গেল সেই সময়ের বিশিষ্ট বাঙালি আনন্দসুন্দর ঠাকুরের সঙ্গে।
কথায় কথায় তারাশঙ্কর তাঁকে জানালেন- ‘‘একটা কিছু ধরতে চেয়ে যেন ধরতে পারছি না। তার জন্য আমার মনে অশান্তির শেষ নেই।’’
তা শুনে আনন্দসুন্দর বললেন- ‘‘আপনার সাধনার পথ হল সাহিত্য। তাকেই জীবনের সাধনা করুন, শান্তি পাবেন।’’
ফিরে এলেন কলকাতায়। নিজের মা-কে গুরু করে দীক্ষা নিলেন। নিত্যপুজো, চণ্ডী, গীতা-পাঠ চলতে থাকল। তাও যেন শান্তি মিলছে না, কী যেন জীবন ছেড়ে চলেই গেছে চিরকালের মতো।
এমনই এক সময়ে বর্ধমানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। হাওড়া-স্টেশন পৌঁছেও তিনি ট্রেনে না চেপে বসে রইলেন প্ল্যাটফর্মে।
দেখা হল বহুদিনের বন্ধু ভ্রাতৃপ্রতিম জগদীশ ভট্টাচার্যর সঙ্গে।
ধমকই দিয়ে বসলেন তিনি— ‘‘এসব কী করছেন দাদা! আপনার এমন আচরণে গোটা বাংলার মানুষ ছিঃ ছিঃ করছে! আপনার নিন্দুকদের কথাই তা’হলে সত্যি হল?’’
-‘‘কী সত্যি হল?’’
-‘‘তাঁরা বলে আপনি শেষ। আর কখনও লিখতে পারবেন না।’’
এমন কথায় যেন যেন কেঁপে উঠলেন তারাশঙ্কর। এবার সাহিত্যিকের অহংকারে ধাক্কা লাগল বহুকাল পর।
পুজোর আর মাত্র আড়াই-মাস বাকি। ভেবেছিলেন কিছুই লিখবেন না, আর সেই বছরই ওই অল্পসময়ে চারটে পুজো সংখ্যায় লিখলেন গল্প। দেশ পত্রিকায় লিখলেন ‘রাধা’, আনন্দবাজার-এ ‘বিচারক’ এবং শনিবারের চিঠি-তে একটি একাঙ্কিকা আর তরুণের স্বপ্ন-য় ‘পঞ্চপুত্তলী’। প্রকাশ পাওয়া মাত্র আবার হই-হই পড়ে গেল পাঠক মহলে।
ফিরে এসেছেন, তারাশঙ্কর আবার ফিরে এসেছেন! আর ‘গণদেবতা’-র লেখক ফিরে পেলেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া শান্তি।
বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী এবং ২টি ভ্রমণ কাহিনি।
এই বিশিষ্ট সাহিত্যিক রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার এবং পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭১ সালের আজকের দিনে (১৪ সেপ্টেম্বর) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment