জন্মদিনে স্মরণঃ তা জ উ দ্দী ন আ হ ম দ
”তাজউদ্দীন দেশকে জানতেন, বুঝতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি যেভাবে মোকাবিলা করেছিলেন, তাতে আমরা খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। সে সময় তাঁকে বহু প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে।”
[শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী/সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ভারত]
বাবলু ভট্টাচার্য : তাজউদ্দীন আহমদ নৈতিক রাজনীতির যে চর্চা জীবনভর করেছেন, কোনো পরিস্থিতিতেই সেই পথ ছাড়েননি বলেই হয়তো এখনও এতটা উজ্জ্বল হয়ে আছেন। সেটাই হয়তো তাঁর সফলতার প্রধানতম ভিত্তি।
তিনি সব সময় ছোটবড় সবাইকে মূল্য দিতেন। সবার কথা ধৈর্য ধরে শুনতেন। কখনও কিছু করতে বলার আগে নিজে সেটা করতেন। নিজেকে যাচাই করে নিতেন এভাবেই।
তিনি কখনও প্রশংসা শুনতে পছন্দ করতেন না। বরং সমালোচনা শুনতেই উৎসাহ বোধ করতেন। সব সময় তিনি দেশের ভালোমন্দ সামনে রেখেই কথা বলতেন। একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। সর্বগুণে গুণান্বিত মানুষ বলা যায় তাঁকে।
তাজউদ্দীন আহমদ মাত্র ৫০ বছরের জীবন পেয়েছিলেন। কিন্তু এই স্বল্পায়ু জীবনেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মতো বড় কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের জেলখানায় বন্দি, তখন তাজউদ্দীন আহমদ সেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।
দেশ স্বাধীন করা এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে জীবিত ফিরিয়ে আনার মতো সফল ও অসামান্য কাজে যুক্ত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর সম্পর্কে তাই শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিমের বয়ান ছিল- ‘তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের সমকালীন সাথীদের অন্যতম সেই ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসের গতিপথকে সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন। যিনি ইতিহাসের সঙ্গে গেছেন।’
তিনি অর্থনীতি এবং আইনের ছাত্র হলেও বিশ্ব ইতিহাসের পঠন ছিল তাঁর করায়ত্ত। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতেন এই বলে, ‘আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি, ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে, তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাজউদ্দীন আহমদের গ্রামের বাড়িটি ছিল পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি আর্মিরা তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো গ্রামের সেই পোড়া বাড়িতে গিয়েছেন তিনি। তাঁকে দেখতে এসেছেন গ্রামের অনেক মানুষ। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন তাঁকে বললেন, আর চিন্তা কী, তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।
উত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন- ‘যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে না, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না। মনে রাখবেন, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না। আমি সমস্ত বাংলাদেশের।আমি স্বার্থপরের মতো আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমান ভাগ করে দিতে হবে।’
এই ছিল পুরোদস্তুর গণতান্ত্রিক, মানবিক, কল্যাণমুখী অর্থনীতির আকাঙ্ক্ষী, দেশপ্রেমিক, সৎ তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। ফলে দলের মধ্যে ও দলের বাইরে সর্বত্রই একদল স্বার্থান্বেষী, সুবিধাবাদী, অগণতান্ত্রিক, অনাদর্শিক মানুষের সঙ্গে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে জীবনভর।
তাজউদ্দীন আহমদ সাম্যের বাংলাদেশ চেয়েছেন, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের অন্যায্য আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করতে চেয়েছেন, সব ধরনের এজেন্সি-নির্ভর সংস্কৃতির বদলে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের গণতান্ত্রিক ন্যায়ানুগ মর্যাদাবান রাষ্ট্র চেয়েছেন। এক অর্থে সেটাই ছিল তাঁর পথ।
তাজউদ্দীন আহমদ এরপর আর খুব বেশিদিন বাঁচেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর কুখ্যাত জেলহত্যাকাণ্ডে তাঁকেও খুন করা হয় একই বছরের নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের আজকের দিনে (২৩ জুলাই) গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment