জন্মদিনে স্মরণঃ স্যা র ডে ভি ড অ্যা টে ন ব রো
বাবলু ভট্টাচার্য : প্রকৃতির বিস্ময় ও রহস্যকে জানার জন্য, মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যারা আজ ঘুরে বেড়ান তাদের কাছে স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা।
স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো এমন একজন মানুষ যার কারণে পৃথিবীর সাধারণ মানুষরা প্রকৃতির পাঠশালার প্রতি সচেতন হয়ে উঠেছে। তার আবিষ্কারমনস্ক, অভিযানপ্রিয় ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ডকুমেন্টারিগুলোর প্রশংসা করেন না এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রকৃতির বিষয় নিয়েও যে এত আনন্দদায়ক ও বিস্ময়কর টিভি অনুষ্ঠান হতে পারে তা তার আগে আর কেউ ভাবেনি।
অ্যাটেনবরো পড়াশোনা করেছেন কেমব্রিজের ক্লেয়ার কলেজে। ১৯৪৭ সালে সেখান থেকেই এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করার পর ১৯৪৯ সালে একটি প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি শুরু করেন। ১৯৫২ সালে ব্রিটিশ ব্রডক্যাস্টিং কর্পোরেশন তথা বিবিসি-র একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের পর তিনি বিবিসির সাথে যুক্ত হয়ে যান। তার জীবন শুরু হয় টেলিভিশন প্রযোজক হিসেবে।
সরীসৃপ সংরক্ষণবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক জ্যাক লেস্টারের সাথে মিলে ১৯৫৪ সালে ২৮ বছরের যুবক ডেভিড অ্যাটেনবরোর প্রযোজনায় বিবিসিতে প্রথম প্রচারিত হয় ‘জু কোয়েস্ট’। এই অনুষ্ঠানে বনে এবং চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের সরাসরি দেখানো হতো।
অনুষ্ঠানটি তুমুল জনপ্রিয় হয় এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান নির্মাতা থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকও বুঝতে পারলো আর দশটি অনুষ্ঠানের মতো বন্যপ্রাণী বিষয়ক অনুষ্ঠানও চিত্তাকর্ষক ও আনন্দদায়ক করে নির্মাণ করা সম্ভব।
সফলভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও উপস্থাপন করানোর মাধ্যমে বিজ্ঞান, প্রকৃতি, সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান ও প্রামাণ্যচিত্রকে তিনি ধীরে ধীরে মূল ধারার অনুষ্ঠান হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলেন।
বিবিসির অনুষ্ঠান বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় ১৯৬৯ সালে তিনি ‘মন্টি পাইথন’স ফ্লায়িং সার্কাস’ নামের অভিনব একটি রম্য অনুষ্ঠান সম্প্রচার ব্যবস্থা করেন। অনুষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতিলাভ করে এবং পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের রম্য অভিনয়কে প্রভাবিত করে।
বিবিসি’র নির্বাহীর কাজটি ছেড়ে দেওয়ার পর অ্যাটেনবরো একজন অভিযাত্রী পর্যটক হিসেবে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন এবং নতুন নতুন টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর নতুন রূপকে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন শুরু করেন।
এমনও অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিস্তারিত বিবরণ তার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যার সম্পর্কে ইউরোপের কোনো ধারণাই ছিল না। জীবনধারণে আমাদের আত্মকেন্দ্রীক উচ্চকিত ধারণার বাইরেও যে মানুষের সংস্কৃতি আর অর্জনের আরো বহুমুখিতা থাকতে পারে, তা তিনি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
১৯৭৯ সালে অভূতপূর্ব ক্যামেরা কৌশল আর অভিনব ছবির মাধ্যমে প্রাণীজগতের অকৃত্রিম বিবরণ সমৃদ্ধ প্রামাণ্যচিত্র ‘লাইফ অন আর্থ’ নির্মাণ করেন। বলা হয়, সে সময় প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই প্রামাণ্যচিত্রটি সরাসরি উপভোগ করেছিল।
ডেভিড অ্যাটেনবরো এবং তার সহযোগীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও কার্যকরী উদ্যোগ ছাড়া আমরা সম্ভবত এই গ্রহের অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেই পারতাম না। ১৯৫০ সাল থেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘জু কোয়েস্ট’, টেলিভিশন পর্দায় প্রথমবারের মতো কমোডো ড্রাগনের উপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের মতো বহু চমকে দেওয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি আমাদের প্রকৃতি সর্ম্পকে জানিয়েছেন।
২০১৭-এর ‘ব্লু প্ল্যানেট ২’ এর মাধ্যমে তিনি এক নতুন অদেখা জগত সম্পর্কে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি জাগরণের উদ্যোগ নেন। এই ধারাবাহিকের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গভীর সাগরের অদেখা বিস্ময়কর জগৎ দেখে কোটি মানুষ শিহরিত হয়ে ওঠে। হেয়ারি অ্যাংগলার ফিশ ও ডাম্বো অক্টোপাসের মতো সামুদ্রিক প্রাণীকে তিনিই প্রথমবারের মতো ক্যামেরায় ধারণ করেন।
স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো সবসময় বলে এসেছেন, তিনি টিভি প্রোগ্রামের উপস্থাপক হয়েছেন বলে প্রকৃতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেননি। বরং তার মাথায় সব সময় প্রকৃতির রহস্য উপভোগের বিষয়টি কাজ করেছে। এটা তার জীবনে প্রেমের মতো পরমানন্দদায়ক।
পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে তার তৈরি প্রামাণ্যচিত্রগুলো সাবলীল ভঙ্গিতে দর্শকদের চিন্তাকে উস্কে দিয়ে চলেছে। বর্ণনাশৈলীর এমন সারল্য ও গভীরতা বিপন্ন পরিবেশ রক্ষায় আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তোলে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বহু রাষ্ট্রপ্রধান তার অনুরাগী। অজস্র ভক্ত ও অনুরাগীকে জীবনের বিস্তৃতি ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য বিষয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার ক্ষেত্রে স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো এ সময়ের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।
স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো ১৯২৬ সালের আজকের দিনে (৮ মে) লন্ডনের আইলওয়ার্থে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment