Press "Enter" to skip to content

ঠিকুজিতে তাঁর নাম রাখা হয় অধরচন্দ্র। বাবা সাধ করে নাম রেখেছিলেন প্রবোধচন্দ্র। গায়ের রং কালো ছিল বলে সবাই ডাকত কালো মানিক। শেষে শুধু রয়ে যায় ‘মানিক’………..।

Spread the love

স্মরণঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবলু ভট্টাচার্য : ব্রাহ্মণ সন্তান বলে কথা! গণক ডেকে জন্মের তিথি ক্ষণ বিচার করে রাহু কেতু শনি মঙ্গলের দশা নির্ণয় করে তৈরি করা হ’ল ঠিকুজি। ঠিকুজিতে তাঁর নাম রাখা হয় অধরচন্দ্র। বাবা সাধ করে নাম রেখেছিলেন প্রবোধচন্দ্র। গায়ের রং কালো ছিল বলে সবাই ডাকত কালো মানিক। শেষে শুধু রয়ে যায় ‘মানিক’।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে বিহারের সাওতাল পরগনা, বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বিক্রমপুরে।

মধুসূদন দত্তের বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ ঘটেছিল একপ্রকার চ্যালেঞ্জ করে। ইনিও তাই! বন্ধুরা বলেছিল নামী লেখকের লেখা ছাড়া কোনো লেখা ‘নামকরা’ পত্রিকা ছাপে না। তিনি বাজি ধরলেন ভালো লেখা হলে তা ছাপা হবেই। ‘অতসীমামি’ নামের সেই গল্প ছাপা হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে।

তিনি লিখেছেন– ‘ভাবলাম এই উচ্ছ্বাসময় গল্প নিছক পাঠকের মনভুলানো গল্প, এতে নিজের নাম দেব না। পরে যখন নিজের নামে ভালো লেখা লিখব, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু ক’জনকে জানিয়ে গল্পে নাম দিলাম ডাকনাম মানিক।’

পরীক্ষায় বরাবর ভাল রেজাল্ট। কলেজে পড়ার সময় জড়িয়ে পড়লেন সক্রিয় বাম রাজনীতিতে। তার সঙ্গে দিনরাত সাহিত্য চর্চা। বিএসসি-তে পরপর দু’বার ফেল মেরে গেলেন। পড়াশোনার যাবতীয় খরচ চালাতেন বড়দা। খবর পেয়ে চিঠিতে লিখলেন– ‘‘তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে, ফেল কেন করেছ, তার কৈফিয়ত দাও।’’

উত্তরে মানিক লিখলেন, গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে দাদা বললেন, ‘‘তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন দাদা।

উত্তরে মানিক লিখলেন, ‘‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’’

দুরন্ত আর অসম্ভব জেদি ছিলেন ছোট থেকেই। মাছ কাটার বঁটি দিয়ে নিজের নাভির এপাশ ওপাশ কেটে দু’ফাল করে ফেলেছিলেন। নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে গেছিল। হাসপাতালে সেই অবস্থাতেই রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ করে বেড়িয়েছিলেন। দারুণ ব্যথা পেলে কিছুতেই কাঁদতেন না, সুর করে গান ধরতেন। ব্যথা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চড়ত সুর। আর দু’চোখে নামত ধারা।

তবে এই ডাকাবুকো মানিকের ভবিষ্যৎ-জীবন সুখকর হল না খুব। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখুর মতো বলবান হয়েও এই মানিককে ঘা-এর মতো গ্রাস করে ফেলল নিদারুণ দারিদ্র্য। আক্রান্ত হলেন মৃগীরোগে। শরীর পুরো ভেঙে গেল। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ধরলেন মদ। ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, লিভার নষ্ট হতে থাকা মানিক প্রায় ধ্বংস। সঙ্গে চূড়ান্ত অনটন। তাঁর মধ্যেই অমানুষিক পরিশ্রম করে লিখে ফেলেছেন যুগান্তকারী সব লেখা!

স্ত্রী কমলা এক মৃত সন্তান প্রসব করেছেন, মানিক ডায়েরিতে লিখলেন, ‘‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’’ কী নৃশংস দৃশ্য!

একদিন চরম অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে মানিককে। সুভাষ, মানিকের স্ত্রী’কে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁকে আগে ফোন করা হয়নি কেন। ম্লান হেসে কমলা উত্তর দিলেন, ‘‘তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।’’ ঘরে সেটুকুও নেই!

একদিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যার লেখা দিতে যাচ্ছেন রাস্তায় দেখা বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে। মানিকের ভেঙে যাওয়া শরীর, মলিন জামাকাপড় দেখে খুব খারাপ লাগল দেবীপদর। জোর করে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। ক্লান্ত মানিককে খেতে দিলেন দেবীপদর মা। বড় তৃপ্তি করে সেই খাবারটুকু খেলেন মানিক।

তারপর যে মানিক একদিন সদর্পে বলেছিলেন আমি শুধু সাহিত্যিকই হব, সেই মানিককে আড়াল থেকে পুতুলের মতো খেলিয়ে কেউ যেন বলিয়ে নিল, ‘‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫৬ সালের আজকের দিনে (৩ ডিসেম্বর) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.