জন্মদিনে স্মরণঃ ছা য়া দে বী
বাবলু ভট্টাচার্য : বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ভুলতে না-পারা অভিনেত্রীর নাম ছায়াদেবী।
ছায়াদেবী যখন অভিনয়ে আসেন তখন বাংলা সিনেমা সবে কথা বলতে শিখেছে। সবাক চলচ্চিত্রের সেই প্রথম যুগে যখন ভদ্রঘরের মেয়েদের সিনেমায় অভিনয় নিয়ে নানান বাঁকা মন্তব্য, তখন সেই সময়ের এক উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছায়াদেবী অভিনয়ে এলেন খানিকটা বাড়ির লোকেদের উৎসাহেই।
ছায়া, যার পিতৃদত্ত নাম ছিল ‘কনক’। ছোটোবেলা থেকেই স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তায় বেড়ে ওঠা এই মেয়ের চোখে ছিল ডানা মেলার স্বপ্ন। কিন্তু মাঝেমধ্যে বিধি বাম হয়ে যায়। ফলে মাত্র এগারো বছর বয়সে স্বামীর ঘর করতে এসে কনককে শুনতে হল যে সেই মানুষটির এ সংসারে মন নেই। বিয়ে জিনিসটি ঠিক কী, তা বুঝে ওঠার আগেই নতুন বর তার বউকে ফেলে চলে গেল ওড়িশায় অধ্যাপনা করতে। কনক বুঝলেন তার একা থাকার সেই হল শুরু।
সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকা কনককে তার বাবা হারাধন তখন নিয়ে এলেন কলকাতায়।
পাশেই থাকতেন সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে। সম্পর্কে যিনি মান্না দে’র কাকা। সব মনখারাপ যেন চলে যেত কৃষ্ণচন্দ্রের সুরে। তাই ভাগলপুরে থাকতেই দামোদর মিশ্রের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের হাতেখড়ি হওয়া কনক ফের গান শিখতে শুরু করলেন তার ‘বাবুকাকা’ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। পাশাপাশি চলল শ্রদ্ধেয় শম্ভু মহারাজের কাছে উচ্চাঙ্গ নৃত্যের তালিম।
জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পথের শেষে’ দিয়েই অভিনয় জগতে পথচলা শুরু হল কনকের, প্রথম ছবিতেই তাঁর নাম বদলে রাখা হয় ‘ছায়াদেবী’।
১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমায় ছায়ার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বিখ্যাত পরিচালক দেবকীকুমার বসু তাঁর ‘সোনার সংসার’-এর নায়িকা হিসেবে চাইলেন ছায়াদেবীকে। ছবিটি মুক্তি পেতেই অজস্র পুরস্কার এল তাঁর ঝুলিতে। এরপর দেবকীবাবু বাংলা ও হিন্দিতে বানালেন ‘বিদ্যাপতি’। রানি লক্ষ্মীর চরিত্রে সিনেমাপ্রেমীদের যেন বশ করলেন ছায়াদেবী, তখন তিনি বয়সেও খানিক পরিণত।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলা সিনেমায় এরপর সূচনা হল সাদা কালো এক স্বর্ণযুগের। ছায়াদেবী তখন চরিত্রাভিনেত্রী। তাঁর বলিষ্ঠ ও দৃপ্ত অভিনয়ের ছটায় ঢাকা পড়েন নায়কনায়িকারা তবু শ্রদ্ধার আসনটি রইল অটুট। কারণ, ওই বাজখাঁই মেজাজ আর তুখোড় অভিনয় দক্ষতা। ক্যামেরার সামনে ছায়াদেবীর অভিনয়ে কখনও ম্লান হয়ে যায় নায়ক-নায়িকা।
ভালোকে ভালো বলার অসামান্য গুণ ছিল ছায়াদেবীর। তাই তাঁর চেয়ে জুনিয়রদের ভালো কাজে সবসময় দেদার প্রশংসা করেছেন তিনি। চরিত্রের গভীরে ডুবে যাওয়া উত্তমকুমারকে শুধু তাঁর অসামান্য অভিনয় গুণের জন্যই স্নেহ করতেন না ছায়াদেবী, ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’র মা-ছেলের সম্পর্ক বাস্তবেও তেমন সত্যিই ছিল।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পর্দার মা ছায়াদেবীর সঙ্গে রিয়েল লাইফেও মিসেস সেনের সম্পর্ক ছিল বড়োই আপন। আত্মপ্রচার, ভিড়ভাট্টায় তীব্র অনীহায় অন্তরালবাসিনী ছায়া দেবীর সঙ্গে সাধারণ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া মহানায়িকার শেষদিন পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল ফোনে।
ছায়াদেবী-ছবি বিশ্বাস নিয়ে যেন তখন বাংলা ছায়াছবি। অভিজাত চরিত্রে ছবি বিশ্বাস থাকা মানেই দর্শক নিশ্চিত যে সে ছবিতে ছবি বিশ্বাসের ঘরনি ছায়াদেবী। আর এভাবেই অবলীলায় জীবন্ত হয়ে উঠেছেন ‘পদিপিসি’, ‘সাত পাকে বাঁধা’র মিসেস বসু, ‘আপনজন’-এর আনন্দময়ী।
সংসার জীবনের শুরুতেই কাঁচা মন ভাঙার যন্ত্রণা বুকে ধারণ করতে হয়েছিল যে মানুষটিকে, শুধু অভিনয়ে নয়, তাঁর সমগ্র জীবনেই যে অনুভবের তীব্র ছোঁয়াচ থাকবে, এতে আর আশ্চর্য কী ! ‘দেয়া নেয়া’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘হারমোনিয়াম’-এর ছায়াদেবী তাই কখনও দর্শককে বুঝতে দেন না যে তিনি অভিনয় করছেন। সবসময় এতটাই সাবলীল আর প্রাণবন্ত তাঁর সংলাপোচ্চারণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।
২০০১ সালের ২৭ এপ্রিল মৃত্যু হয় ছায়াদেবীর।
ছায়াদেবী ১৯১৪সালের আজকের দিনে (৩ জুন) ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment