Press "Enter" to skip to content

জীবনে টাকাই সব- ছোটদের এখন কেউই বোধহয় আর ‘ভাল মানুষ হও’ কথাটা বলেন না….।

Spread the love

চন্দন রুদ্র : কলকাতা, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫। আজ মহা ষষ্ঠী। বৃষ্টির ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তৃতীয়া থেকেই পথে মানুষের ঢল। মঙ্গলবার অতিবৃষ্টিতে জলমগ্ন কলকাতা শহরে তড়িদাহত হয়ে অকালেই কিছু মানুষের প্রাণ ঝরে গিয়েছে। শারদীয়া উৎসবের আবহে ভিন রাজ্য থেকে এসেছে আরও প্রাণহানির খবর। তামিলনাড়ুর কারুরে অভিনেতা, টিভিকে প্রধান বিজয়ের জনসভায় মর্মান্তিক ভাবে পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন শিশু সহ অনেক নিরীহ মানুষ।

তবে উৎসব তো আর থেমে থাকে না। আসলে কোনও কিছুর জন্যই কিছু থেমে থাকে না। জীবন চলমান। সময়ও এগিয়ে যায়। সময় তো নদীর স্রোতের মতো। চলে গেলে আর ফিরে আসে না। আমরাও কালের নিয়মে এগিয়ে চলি।

আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে ২০১৫ সালে ৮৮ ফুট উচ্চতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা প্রতিমা বানিয়ে সাড়া ফেলেছিল দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক দুর্গাপুজো কমিটি। এ বার ৬ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে তাইল্যান্ডের বজরার আদলে সাততলা বাড়ির উচ্চতার সবচেয়ে বড় পুজো মণ্ডপ গড়ে ফেলার দাবি করেছে দেশপ্রিয় পার্ক। এই পুজোর কাছেই শহরের ফুটপাতে ক্রোড়পতি হয়ে ওঠার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। ছেলেবেলায় লাখপতি হওয়ার কথা শুনেছি। লাখপতি মানেই বড়লোক শ্রেনীর লোক বলে গণ্য হতো। এখন লাখপতি হওয়ার কথা কেউ বলেন না। টাকার দাম কমেছে। এখন তাই ক্রোড়পতির যুগ।

ইদানীং এ রাজ্যে টাকা উড়ছে। সংবাদমাধ্যমে শুধুই কোটি কোটি টাকার খবর। শুধু খবর বলি কেন! রাশি রাশি টাকা উদ্ধারের ছবিও গণমাধ্যমে উঠে আসছে। কারও ফ্ল্যাটে, কারও আলমারিতে কিংবা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মিলছে কোটি কোটি টাকার হদিশ। চুরি, দুর্নীতির অভিযোগে সমাজের অনেক রথী-মহারথীই এখন জেলে।

আসলে টাকাই এখন মুখ্য। বাকি সবকিছুই গৌণ। তবে কি আগে টাকার চাহিদা ছিল না! বিলক্ষণ ছিল। টাকা ছাড়া জীবন অচল। তাই টাকার প্রতি মানুষের চাহিদা চিরন্তন। কিন্তু অতিরিক্ত লোভ? না, আজকের মতো পরিস্থিতির কথা আগে কখনও শুনিনি।

সবাই ভাবেন বলতে পারি না। তবে অনেকেই মনে করেন টাকা থাকলেই উপচে পড়ে সুখ। টাকার বান্ডিলের ভাঁজে ভাঁজে সুখেরা লুটোপুটি খায়। ছোটদের এখন তাই কেউই বোধহয় আর ‘ভাল মানুষ হও’ কথাটা বলেন না। তার বদলে বলেন, ‘বড় চাকুরে হও। অনেক টাকা রোজগার করো’। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের বিচার হচ্ছে এখন টাকায়। আজকের পড়াশোনা শেখা তো কেরিয়ার গড়ার জন্য। ভাল মানুষ হওয়ার জন্য নয়। ভোগবাদের দুনিয়ায় এখন তাই কেউ কোটি টাকার প্যাকেজে চাকরি পাওয়া কোনও অলীক স্বপ্ন নয়। একেবারেই বাস্তব!

টাকার কাছে আমাদের সূক্ষ আবেগ, অনুভূতিগুলো অনেক সময়ই হেরে যাচ্ছে। আজকাল দুটি মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পাচ্ছে সেই টাকাই। অথচ শুধু টাকায় কোনও সম্পর্কই স্থায়ী হয় না। সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিশ্বাসে, সম্পর্ক গড়ে ওঠে সম্মানে, সম্পর্ক গড়ে ওঠে ধৈর্যে। আজকের বহু সম্পর্কই তাই দ্রুত ভাঙছে। বাড়ছে বিচ্ছেদ। কেউ মাছ-ভাত খেয়ে পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী পালন করছেন। কেউ পাঁচতারা হোটেলে ডিনার করেও এক বছর একসঙ্গে কাটাতে পারছেন না। এখন সামান্য টাকার লোভে একজন আর একজনের প্রাণ কেড়ে নিতেও দ্বিধা করে না। তাই সমাজে এত হত্যা, এত খুন, এত হিংসার দাপাদাপি।

এশিয়া কাপে ভারতীয় ক্রিকেটার হার্দিক পাণ্ড্যকে নতুন চুলের ছাঁট নিয়ে খেলতে দেখা যাচ্ছে। সংবাদ সংস্থার খবর, হার্দিককে হাতে ২০ কোটি টাকা মূল্যের ঘড়ি পরে অনুশীলন করতে দেখা গিয়েছে। আজ এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন দল পুরষ্কার হিসেবে যেখানে পাবে ২.৬ কোটি টাকা সেখানে হার্দিকের ঘড়ির মূল্য ওই পুরষ্কার মূল্যের চেয়ে আটগুণ বেশি। হার্দিকের এই ঘড়ির গল্পের পাশে দেশপ্রিয় পার্কের কাছের এক কোটি টাকার লটারি প্রাপ্তির বিজ্ঞাপনটাও যেন একেবারে পানসে মনে হয়।

হার্দিকের ঘড়ির গল্পে প্রয়াত ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক বারই তাঁর কুমোরটুলির বাড়িতে গিয়েছি। কাশ্মীরে পহেলগামে হত্যাকাণ্ড এবং তার জেরে অপারেশন সিঁদুর। এই পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া উচিত কিনা তাই নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে ঠিক এমনই প্রশ্ন কার্গিল যুদ্ধের সময়ও উঠে পড়েছিল। ওই সময় পঙ্কজ রায়ের মতামত জানতে তাঁর বাড়িতে যাই।

ক্রিকেট নিয়ে নানা কথার ফাঁকে পঙ্কজ রায় বলেছিলেন,” এখন ক্রিকেট খেলায় কত টাকা! আমাদের কালে এমন অবস্থা ছিল না। ট্রেনে চড়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে টেস্ট খেলতে যেতাম। অর্থও পেতাম যৎসামান্যই! তবে ক্রিকেট খেলাটাকে আমরা খুব উপভোগ করেছি।” আজকের ক্রিকেটাররা ক্রিকেট খেলাটাকে সেভাবে উপভোগ করে কিনা জানি না। তবে এক বছর আইপিএলে নাম লেখাতে পারলেই হেসে খেলে কোটিপতি হওয়া কে আটকায়!

টাকার কথা লিখতে লিখতে এক ডাক্তারবাবুর কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালের নামী চিকিৎসক। আবার সন্ধ্যায় চেম্বারও করেন। চেম্বার করার কথা বিকেল পাঁচটা থেকে। কিন্তু চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে প্রায়ই তাঁর এক থেকে দেড় ঘন্টা দেরি হয়ে যায়। এদিকে রোগীরাও অধৈর্য হয়ে পড়েন।

একদিন রিসেপশনিস্ট দিদির কাছে অনুযোগ নিয়ে হাজির হলাম। তিনি শুনে বললেন,” কী আর বলি বলুন! অনেক দিনই চেম্বার শেষ করে ডাক্তারবাবু বলেন,” আজ সেই বিকেল থেকে কিছুই খাওয়া হল না।” ডাক্তারবাবুর কথা শুনে খুব মায়া হল। মনে মনে ভাবলাম, মানুষটা অন্যের শরীর সুস্থ করার কাজ করছেন অথচ নিজে শরীরের প্রতি যত্নশীল নন। এটা চিকিৎসকের দায়বদ্ধতা নাকি অনেক টাকা উপার্জনের নেশা। সে উওর আজও আমার কাছে অজানা।

আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে বড় স্বপ্ন একটাই। অনেক অনেক টাকা উপার্জন। আমাদের ছেলেবেলায় মা-বাবারা এইভাবে জীবনের ‘গোল’ ঠিক করে দেননি। তাই কোনও দিন টাকার পেছনে ছুটতেও শিখিনি। জীবনে শৈশবের অনেকটা সময়ই কেটেছে ঘুড়ি,লাট্টু, ক্রিকেট আর ফুটবলে।

আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন। তবু কিছু মানুষ দীর্ঘস্থায়ী সুখের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটে চলেছেন। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসে ভাইবোন অপু-দুর্গার ট্রেন দেখার জন্য লাগামহীন মরিয়া দৌড়ের কথা আমরা পড়েছি । আজকের সমাজে টাকার নেশায় বুদ হয়ে চলছে সেই রকমই এক লাগামহীন দৌড়। আরও চাই! আরও চাই! আরও…

More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »
More from SocialMore posts in Social »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.