Press "Enter" to skip to content

জিভে জল আনা জয়নগরের মোয়া। যেমন তার মনমাতানো গন্ধ তেমনি তার মনভোলানো স্বাদ….।

Spread the love

মধুমিতা শাস্ত্রী, ৪, ডিসেম্বর, ২০২০ঃ প্রতি বছর শীত আসার সাথে সাথে কিছু অতিথিদের আগমন ঘটে। বলাবাহুল্য এরা আমাদের সবার প্রিয়। আর এদের মধ্যে পয়লা নম্বরে আছে জয়নগরের মোয়া। যেমন তার মনমাতানো গন্ধ তেমনি তার মনভোলানো স্বাদ। আমরা সারাবছর অপেক্ষা করি এর স্বাদ চেটেপুটে নেওয়ার জন্য।

আমাদের সবার মনে একটা প্রশ্ন জাগে, প্রথম কে এই সুস্বাদু মিষ্টি বানালো? আর কীভাবেই বা এর উৎপত্তি হল? এর উত্তর জানার জন্য আমরা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহরুর (জয়নগরের আগের স্টেশন) বিখ্যাত বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গণেশ দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি বললেন, কে প্রথম এই ঐতিহ্যমন্ডিত মিষ্টি বানিয়েছিলেন তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে এর উৎপত্তি সম্পর্কে বাবার মুখ থেকে যা শুনেছি সেটাই বলছি আপনাকে। বহু বছর ধরে জয়নগরের রাধাবল্লভতলায় হয়ে আসছে দোলের মেলা। নতুন কনকচূড় ধানের খইয়ের সঙ্গে সুগন্ধি জিরেন কাটার গুড় মিশিয়ে হাতে গোল পাকিয়ে নাড়ুর মতো বানিয়ে ঠাকুরকে প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করা হতো। জিরেন কাটার গুড় কী? সেটা একটু বলে রাখি। খেজুর গাছ মরসুমে যখন প্রথম কাটা হয় তখন রসটা খুব ভালো মানের অর্থাৎ এর গন্ধ ও স্বাদ ভালো হয় এবং ঘন হয়। একে বলে নলেন পয়লা কাটার রস। এর পর গাছটা রোজ কাটলে রসের স্বাদ আসতে আসতে ফিকে হতে থাকে ও একটু জোলো হয়ে যায়। এই সময় গাছটাকে কিছুদিন জিরেন দেওয়া হয় অর্থাৎ রেস্ট দেওয়া হয়। এরপর আবার গাছ কাটলে যে রস পাওয়া যায় তাকে বলে জিরেন কাটার রস আর এই রসের গুড়কে বলে জিরেন কাটার গুড়। কিছুদিন বাদে কাটার ফলে এই রসের স্বাদ ভালো হয় সুগন্ধি ও ঘন হয়।

এছাড়া গ্রামের কিছু লোক মোয়া বানিয়ে ওই মেলাতে বিক্রি করত। এই মেলার একটি বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। এখানের কদমতলার কদমগাছে অলৌকিক ভাবে দোলের সময় ফুল ফোটে। আর এটা দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে বহু লোকজনের সমাগম হয় মেলাতে। এই সমস্ত মানুষ মেলা থেকে মোয়া কিনে নিয়ে যেত। ধীরে ধীরে স্বাদ ও গন্ধে সবার মন জয় করে নিল মোয়া। এভাবেই প্রত্যন্ত গ্রামের মোয়া নিজ স্বাদ ও গন্ধের জোরে ছড়িয়ে পড়ল দেশ থেকে বিদেশে।

মোয়ার যে উপকরণ তা আমরা সবাই কম বেশি জানি। কিন্তু বানানোর পদ্ধতি? অনেকেই হয়তো ভাববেন ওই তো গুড় আর খই মিশিয়ে। কিন্তু না, একটি বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয় মোয়া। চলুন সেটা জেনে নেওয়া যাক কী পদ্ধতি। দীর্ঘদিন এই ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত গণেশ দাস জানালেন, অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে তবেই তৈরি হয় মোয়া।

প্রথমে ১৫-২০ মিনিট ধরে গুড় এবং চিনির মিশ্রণে নির্দিষ্ট একটা পাক তৈরি করা হয়। এরপর পাকটিকে অন্য একটি পাত্রে ঢেলে ঠাণ্ডা করতে দেওয়া হয়। প্রায় দু-ঘন্টা সময় লাগে এটা ঠান্ডা হতে। একটু ঠাণ্ডা হয়ে এলে ওই পাকে কনকচূড় ধানের খই ভালোভাবে মেশানো হয়। এই মিশ্রণটিকে আবার ১৫-২০ মিনিট রেখে দেওয়া হয়। এরপর কাঁচি ব্যবহার করা হয়। কাঁচি হল চিনি ও গুড়ের মিশ্রণ। ময়রাদের পরিভাষায় এটাকে কাঁচি বলা হয়। এই কাঁচি দিয়ে আরও ভালো করে মেশানো হয়। এর ১৫-২০ মিনিট পর কাজু, কিসমিস, এলাচ, ক্ষীর, মেশানো হয়। এই মিশ্রণটিকে আবার ঢাকা দিয়ে রাখা হয়। যাতে আরও ভালোভাবে খই এবং গুড় মেশে ও নরম হয়। এই অবস্থায় ৪-৫ ঘন্টা রেখে দেওয়া হয়। এরপর ফাইনালি মোয়ার শেপ দেওয়া হয় অর্থাৎ মোয়া বানানো হয়। এরপর গার্নিশিং করে বাজারজাত করা হয়। তবে গিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু মোয়া।

আমরা অনেকেই জানি জয়নগরের মোয়া ইতিমধ্যেই জিআই (জিওগ্রফিক্যাল ইন্ডিকেশন) ট্যাগ পেয়ে গিয়েছে। তবে এই জিআই ট্যাগ কী বা কেন দেওয়া হয় সে বিষয়ে একটু বলে রাখি। জি আই ট্যাগ এর পুরো নাম Geographical Indication tag।যেসব দ্রব্য কোনো বিশেষ নির্দিষ্ট স্থান থেকে পাওয়া যায় সেই স্থানের নাম জুড়ে যায় দ্রব্যটির সঙ্গে, ফলে অন্য কোনো জায়গার বাসিন্দারা দ্রব্যটি তাঁদের জায়গার বলে দাবি করতে পারবেন না।। এই দ্রব্যগুলি খুবই উচ্চ মানের হয় এবং দুস্প্রাপ্য হয়। এই ট্যাগ দেওয়ার উদ্দেশ্য হল, যে স্থান থেকে উৎপন্ন হচ্ছে সেই স্থানের সঙ্গে ওই দ্রব্যটির একটি ভৌগোলিক সম্পর্ক স্থাপন করা। যাতে ওই দ্রব্যের অবৈধ সরবরাহ বন্ধ হয়। এই আইন প্রণয়ন হয় ১৯৯৯ সালে এবং এটি কার্যকর হয় ২০০৩ এর ১৫ ই সেপ্টেম্বর।

বর্তমানে মোয়া ব্যাবসার সামনে অনেক সমস্যা।
বর্তমানে এই ব্যাবসায় যুক্ত যারা অনেকগুলি সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে। আমফান দুর্যোগের ফলে বহু খেজুর গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুনরায় সেই পরিমাণ গাছ রোপন করা হচ্ছে না। ফলে কাঁচামালে টান পড়ছে। অনেক চাষি খেজুর গাছ রাখতে আগ্রহী নয়। বছরে মাত্র কিছুদিন এর থেকে লাভ পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য গাছ বা চাষে এর থেকে বেশি লাভ। ফলে খেজুরগাছের সংখ্যা কমছে।


মোয়া ব্যবসার আরও একটা বড় সমস্যা হলো এই ব্যাবসায় নতুন করে কেউ যুক্ত হতে আগ্রহী নয়। যেহেতু এটা সিজনাল বিজনেস ফলে বছরের অন্য সময় তাকে বসে থাকতে হবে। তাই এই ব্যবসার সম্প্রসারণ হচ্ছে না। এই ব্যাবসার সাথে যুক্ত ব্যাবসায়ীরা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আমরা আশা করব সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে মোয়া ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.