রণবীর ভট্টাচার্য : কলকাতা, ২৫ জুন, ২০২০।ভারত একটি বৃহৎ গনতান্ত্রিক দেশ যেখানে সংবিধানই সব। দেশীয় রাজনীতি অনেক চড়াই উতরাই দেখেছে, আসমুদ্রহিমাচল মানুষের ভোট উৎসবে যোগদান ও দেখে থাকে কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা যেন থেকেই যায়, যা বোধহয় না হলেই ভালো হতো। ঠিক সেরকমই যেন জরুরী অবস্থা যা আজ থেকে ৪৫ বছর আগে জারি করেছিল তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। একদিন নয়, দুই দিন নয়, টানা ২১ মাস জরুরী অবস্থা লাগু ছিল। কেন ইন্দিরা গান্ধী সরকার হঠাৎ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিল? এর কি প্রভাব পড়েছিল দেশীয় রাজনীতিতে?
ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালে দেখা যাবে যে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর অচিরেই কংগ্রেস পার্টির সর্বেসর্বা নেত্রী হয়ে ওঠেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। যেভাবে ভারত তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জন্মের ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নেয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি সাক্ষাৎ দেবী দুর্গা আখ্যা পান। কিন্তু ক্ষমতার প্রতি মোহ, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ডেকে আনে বিপদ। বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ, অকংগ্রেসী রাজ্যে আইন বহির্ভূত ক্ষমতা প্রদর্শন, দেশ জুড়ে রেল রোকো – একের পর এক ঘটনায় সরাসরি সংঘাতের পথে যাচ্ছিল ইন্দিরা গান্ধী সরকার। তবে পরিস্থিতি সঙ্গীন হয়ে ওঠে রাজ নারায়ণ কেসের বিচার নিয়ে। রাজ নারায়ণকে ১৯৭১ এর সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী হারিয়েছিলেন এলাহাবাদ কেন্দ্র থেকে। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট ওই কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করে দেয় এবং ছয় বছরের জন্যে ইন্দিরা গান্ধীর ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার কেড়ে নেয়। পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্ট এই রায় বহাল রাখে। এই অবস্থায় ক্ষমতায় থাকার জন্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদকে অনুরোধ করেন জরুরী অবস্থা জারি করার জন্য। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫২(১) ধারা অনুসারে জরুরী অবস্থা ঘোষণা হয় সারা দেশে।
সামগ্রিক ভাবে, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার দেশ বিদেশে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। পুলিশের জুলুমবাজি, রাজনৈতিক বন্দিদের উপর অত্যাচার, গণমাধ্যমের উপর হস্তক্ষেপ, সংবিধান পরিবর্তন করে মানুষের সম্মতি না নিয়েই নতুন আইন আনা, জন সংখ্যায় লাগাম দেওয়ার জন্য জোর করে পুরুষদের নির্বিজকরনের অভিযোগ ওঠে যার বেশিরভাগই মিথ্যে ছিল না। রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরের রথী মহীরথীদের অনেকেই ছিলেন জেলের ভেতর – জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাজ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী প্রমুখ নেতারা তো ছিলেনই, বিভিন্ন রাজ্যে দমন পীড়ন নীতি তৈরি করেছিল রাজনৈতিক শূন্যতা। অ্যামনেশটি ইন্টারন্যাশনাল অনুসারে সারা দেশের প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষ কারাবাস পালন করেছিলেন এই সময়ে।
৪৫ বছর পর কেটে গিয়েছে এর মধ্যে, রাজনীতিক পট পরিবর্তন হয়েছে অনেক। কিন্তু জরুরী অবস্থা সারা দেশের মানুষকে বুঝিয়েছিল গনতন্ত্রের মহিমা। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ও গনতান্ত্রিক অধিকার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা উপলব্ধি করেছিল পুরো দেশ। তাই আজও যখন কোন রাজনৈতিক দল কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, মানুষ তাদের মনে করিয়ে দেয় তাদের দায় দায়িত্ব নিয়ে। গর্বের ব্যাপার যে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো যেখানে সামরিক সরকার দেখেছে, সেখানে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ কিন্তু গনতন্ত্রে অবিচল থেকেছে। এখানেই বোধহয় জরুরী অবস্থার শাপমুক্তি ঘটেছে বৃহত্তর ভারতীয় গনতন্ত্রের।
Be First to Comment