জন্মদিনে স্মরণঃ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বাবলু ভট্টাচার্য : বিকেল ফুরিয়ে আসছে। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে লাল আকাশের দিকে চেয়ে আছে ছেলেটি। সে অপেক্ষা করছে সন্ধে নামার।
ও দিকে তার অপেক্ষায় থেকে থেকে দিশেহারা উদ্যোক্তারা। সে না গেলে যে পালাগান শুরু করতে পারছেন না তারা। জমিদার বাড়ির ছেলেটাই যে তাদের ‘পাণ্ডবগৌরব’ নাটকের নির্দেশক-অভিনেতা। এ দিকে সে নাটক করছে জানতে পেরে, তাকে বন্দি করে রেখেছে রক্ষণশীল বাবা-কাকারা। তাদের বিশ্বাস, অভিনয়ে নামলে মেয়েমানুষের সংস্পর্শে ছেলেটা বখে যাবে!
বাড়ির লোক যা-ই ভাবুক, ছেলেটা সংকল্প করেই নিয়েছে। সন্ধে নামতেই সে জানালার শিক বেঁকিয়ে, কাপড় ঝুলিয়ে একতলার কার্নিশে বেয়ে নেমে অন্ধকারে দৌড়। একেবারে গ্রিনরুম। দ্বিতীয় পাণ্ডবের মেকআপ নিয়ে সোজা মঞ্চে!
অভিনয়ের জন্য ঘর-পালানো সে দিনের এই ডাকাবুকো ছেলেটিই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাবা তারকনাথ ছিলেন রাশভারী জমিদার। বেশির ভাগ সময় তিনি বাইরে থাকতেন। বাড়িতে কাকা যদুনাথের নজর এড়িয়ে মা অন্নপূর্ণার কাছেই চলত আদর-আবদার। খুব ছোটবেলায় গ্রামের যাত্রা-থিয়েটার দেখেই দুর্গাদাসের শখ হয় সে দলে নাম লেখানোর। কিন্তু বাবা-কাকার ভয়ে তার সব ইচ্ছেই বাড়তে থাকে মনের গহনে। দোল-দুর্গোৎসবে অপেরা দলের যাত্রা দেখে দলও খুলে ফেলে গোপনে।
ঠিক করলেন, নতুন করে অভিনয় নিয়ে মেতে উঠবেন। দু’চোখে শুধু অভিনয়ের স্বপ্ন। ঘরে ফিরে সংসারে মন নেই তাঁর। বিপদ বুঝে দুর্গাদাসের বিয়ে দিলেন অভিভাবকরা। কিন্তু তবুও সংসার তাঁকে জড়াতে পারল না!
স্ত্রী বীণাপাণিকে অনুনয় করে, গভীর রাতে জানালা গলে চুপি চুপি পালিয়ে যেতেন রিহার্সালে। ফিরতেন নিশি ভোরে। মদ ধরেছেন, নেশায় দু’চোখ টকটকে লাল। বীণাপাণি বুঝতেন দুর্গাদাসের কষ্ট, কিছু বলতেন না। এ ভাবেই কাটল তিন বছর।
রাজপথে অন্যমনস্ক হাঁটছিলেন দুর্গাদাস। পিছন থেকে কেউ যেন তাঁকে ডাকলেন।
‘শুনছেন?’
দুর্গাদাস দেখলেন ছিপছিপে এক ভদ্রলোক। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন।’
আপনি কি কোনও থিয়েটারে কাজ করেন? অভিনয় করবেন? আমি একটি নতুন মুখ খুঁজছি।’
‘অভিনয়!’ দুর্গাদাস যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। উল্টো দিকের ভদ্রলোক ততক্ষণে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যাচ্ছেন, ‘আমি নরেশচন্দ্র মিত্র। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রনাথ’ নামাচ্ছি। কিন্তু চন্দ্রনাথকে পাচ্ছি না। আপনাকে আমার পছন্দ। করবেন অভিনয়?’
রাজি হয়ে গেলেন দুর্গাদাস। নরেশ মিত্তিরের হাত ধরে চলে গেলেন দমদমে কাক্কু ঘোষের বাগানবাড়িতে শ্যুটিংয়ে। নায়ক চরিত্রে অভিনয় করলেন সুদর্শন দুর্গাচরণ। ১০ রিলের এই ছবি থেকেই দুর্গাচরণ নাম বদলে নিলেন শিল্পী। ক্রমে দর্শকের কাছে দুর্গাদাস হলেন শ্রদ্ধার ‘দুগ্গাবাবু।’
অল্প দিনের মধ্যেই নায়কোচিত চেহারা, উদাত্ত মধুর কণ্ঠস্বর, অভিজাত চলন-বলন, সুকান্তি— সবটা মিলিয়ে তিনি এক প্রবল ব্যক্তিত্বরূপে পাদ প্রদীপের আলোয় দেখা দিলেন। সেই প্রবল ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ছিল আত্মপ্রত্যয়ে, যা প্রায়শই দাম্ভিকতা বলে মনে হতো। ১৯২৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত বাংলা মঞ্চ এবং রূপালী পর্দায় দুর্গাদাসের ছিল একচ্ছত্র রাজত্ব। ওই সময়ে তিনি যা পারিশ্রমিক দাবী করতেন, তাই পেতেন।
একে একে দুর্গাদাস প্রায় ১৯টি নির্বাক ছবিতে অভিনয় করলেন— ‘জেলের মেয়ে’, ‘মিশর রানি, ‘ধর্মপত্নী’, ‘সরলা’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রজনী’, ‘ইন্দিরা’, ‘রাধারানী’ প্রভৃতি। তাঁর শেষ নির্বাক ছবি ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ মুক্তি পেল ১৯৩২ সালের এপ্রিলে। সহশিল্পী প্রমথেশ বড়ুয়া, সবিতা দেবী। সব ছবির মতো সে ছবিতেও দুর্গাদাস সাফল্য পেলেন!
এদিকে দুর্গাদাসের প্রতিভাময় শিল্পী-জীবনের আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। তার শেষ ছবি-‘প্রিয় বান্ধবী’। এই ছবিতে নায়িকা চন্দ্রাবতীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি যখন নায়কের ভূমিকা করছেন তখন রোগে অমিতাচারে তার শরীর জীর্ণ হয়ে এসেছে। প্রচুর মদ্য পানে ও প্রচুরতর অমিতাচারে প্রতিভাবান নট দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যয়ের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।
সবাক যুগে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৫টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, ছবিগুলো হলো – ১. দেনা পাওনা (নায়িকা – নিভাননী,১৯৩২) ২. কৃষ্ণ কান্তের উইল (নায়িকা- শান্তি গুপ্তা, ১৯৩২) ৩. চিরকুমার সভা (নায়িকা-মলিনা দেবী, ১৯৩২) ৪. চন্ডীদাস (নায়িকা- উমাশশী,১৯৩২) ৫. কপালকুণ্ডলা (নায়িকা- উমাশশী, ১৯৩৩) ৬. মীরাবাঈ (নায়িকা-চন্দ্রাবতী, ১৯৩৩) ৭. মহুয়া (নায়িকা- মলিনা দেবী, ১৯৩৪) ৮.ভাগ্যচক্র (নায়িকা- উমাশশী, ১৯৩৫) ৯. দিদি (নায়িকা- চন্দ্রাবতী, ১৯৩৭) ১০. বিদ্যাপতি (নায়িকা ছায়াদেবী, ১৯৩৮) ১১. দেশের মাটি (নায়িকা-চন্দ্রাবতী, ১৯৩৮) ১২. পরশমনি (নায়িকা রানীবালা, ১৯৩৯) ১৩. ঠিকাদার (নায়িকা রেনুকা রায়ের বাবার ভূমিকায়, ১৯৪০) ১৪. অবতার (নায়িকাজ্যোস্না গুপ্তা, ১৯৪১) ১৫. প্রিয় বান্ধবী (নায়িকা চন্দ্রাবতী, ১৯৪৩)।

তিনি একজন দক্ষ নাট্যভিনেতা ছিলেন। তিনি অন্তত ৪৬টি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। ১৯২৩ সালে স্টার থিয়েটারে ‘কর্ণাজুন’ নাটকে বিকর্ণের ভূমিকায় কৃতিত্ব দেখান। ১৯২৫ সালে ‘চিরকুমার সভা’ নাটকে তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসা পান ।
তার অভিনীত ‘কর্ণাজুন’, ‘খনা’, ‘শকুন্তলা’ প্রভৃতি মঞ্চ নাটকের রেকর্ড এখনও জনপ্রিয়।
১৯৪৩ সালের ২০ জুন এই মহান শিল্পী মাত্র ৫০ বছর বয়েসে মৃত্যু বরণ করেন।
দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৩ সালের আজকের দিনে (৪ ডিসেম্বর) দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গড়িয়ার কালিকাপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

Be First to Comment