Press "Enter" to skip to content

‘ছোটলোক’, কথাটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্বোধন । সেটা, একটু স্নেহের বশেই , বাবা হয়তো বাংলায় না বলে, বলেছেন ইংরিজিতে……।

Spread the love

[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ] (পর্ব=০৫৯)

[মঞ্চ-মায়াবী, জাদুশিল্পী পি সি সরকার, জুনিয়র]
( Dr. Prodip Chandra Sorcar, M. Sc., Ph. D.)
কলকাতা, ১৮ এপ্রিল, ২০২১।
=========আমার কথা আমার মুখে========
না শুনলে, না পড়লে, না বুঝলেও চলবে
এটা আমার আত্ম-প্রচার
কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, এড়িয়ে যেতে পারেন

বয়স আমার যতোই বাড়ুক না কেন, আমি বরাবরের জন্য একটা পাক্কা ‘ছোটলোক’ হয়েই আছি এবং থাকবো। আমার বাবা,’প্রতুল চন্দ্র’, নিশ্চয়ই হয়তো -অনেক আশা নিয়েই আমার নাম রেখেছিলেন – “প্রদীপ”। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ঘন অন্ধকারে, যেখানে হয়তো ওই পারিবারিক চন্দ্রের আলো যথেষ্ট পরিমাণে পৌছুতো না, সেখানে আলো যোগাবে প্রদীপ। কথাটা বাবার নয়। আমার নিজেরই কল্পনা জাত। কারণ জীবন যুদ্ধে, আমার ঠাকুর্দা, ভগবান চন্দ্র সরকার, অষ্টম গর্ভের প্রথম জীবিত প্রকাশ, ‘প্রি-ম্যাচিয়োর্ড বেবী’, হিসেব বাবাকে পেয়ে নাম রেখে ছিলেন ‘প্রতুল’, অর্থাৎ–‘যথেষ্ট’ । নাম করণের পেছনে অনেক ইতিহাস, আবেগ , আবেদন নাকি প্রকাশ পায়। সেজন্যই বললাম।

আমার পুরো নাম, প্রদীপ চন্দ্র সরকার , সংক্ষেপে, সেটাও দেখি আবার আর এক, ‘পি সি সরকার’ । পরবর্তীকালে আমাকে, আমার বাবা ,আমার ওই মাত্রাধিক খ্যাপাটেপনা দেখে, আরও ‘ধীরে সুস্থে’ ভেবেচিন্তেই বোধহয়,জাদুবিদ্যার ইতিহাস বই- এ আমাকে পার্মানেন্ট একটা ‘ছোটলোক’ বানিয়ে ঠাই দিয়েছেন।
তবে ওই ‘ছোটলোক’, কথাটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্বোধন । সেটা, একটু স্নেহের বশেই , বাবা হয়তো বাংলায় না বলে, বলেছেন ইংরিজিতে। “জুনিয়র”। ” পি সি সরকার জুনিয়র”। উনি ওনার “HIstory of Magic ” বইতে লিখেছেন:
“…. In Magic Show business, the mantle is taken by the talented sons as the successors to their father with his same name. So, we have BLACKSTONE (Junior), RICHIARDI (Junior), KIO (Junior), CARTER the Great (Junior) and the author is to be succeeded by SORCAR(Junior). His second son Prodip Chandra SORCAR,…. He is already a stage-illusionist and has been trained to take over his father’s big stage illusion ‘IND-DRA-JAL.’ Readers know him by his Magic at the Bay of Bengal where he escaped from a locked, welded and chained box thrown in the sea under careful scrutiny and in full view of the journalists, radio and television critics and cameramen in broad day light. ”

আমি কিন্তু খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এই ‘জুনিয়র’ বিশেষণটা কি আসলে একটা বকুনি, অপবাদ নাকি গালাগাল ?! কারণ, আমাদের দেশে ‘জুনিয়র’ কথাটার মানে তো সঠিক অর্থে ব্যবহৃত হয় না। এর ভাব গত অর্থ নাকি -‘খোকা!’ , ‘বয়সে অপরিণত’, ‘বাচ্চা’ । সোজা কথায় ‘এলেবেলে’।

প্রশ্ন জাগে, আমি কি তাহলে, তেমনই একটা কিছু? আমাদের দেশের শিক্ষায়, পরিবেশে, জন-চিত্তের যেমন বিস্তৃতি এবং মানসিকতার যা গভীরতা, তাতে বিকৃত মানেটাই তো সবাই সব্বার আগে ভেবে বসেন। ভাবেন, ছোটদের ফুটবল, ক্রিকেট খেলার ‘জুনিয়র’ সেকশনের মতো ছোট্ট খোকা-টোকাদের টিফিন আর ওয়াটার বটল্ হাতে খেলার একটা কিছু। ভাগ্যিস্ পরিস্কার বায়ু নিয়ে ‘বড়ে ‘ গুলাম আলীর পর তখন ‘ছোটে’ গুলাম আলীর, আবির্ভাব ঘটেছিলো। উর্দু বা ফার্সী ভাষার দৌলতে বয়সে জ্যেষ্ঠতার চিহ্নিতকরণে, এর মানে না বুঝেই, লোকমুখে শুরু হয়ে ছিল এর প্রচলন। তার আগে, বয়সের বড়-ছোট দিয়ে আলাদা মানুষকে চিহ্নিতকরনের কনসেপ্টটা ভারতীয় জনগণের মাথায় খেলতো না। তখনোও চলছে ক্রমিক নম্বর দিয়ে পরিচয়। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর ‘দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত’র, তারপর ‘তৃতীয়’-র মতো এমন একটা কিছু! কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তো তা চলবে না। প্রথম পি সি সরকার, তারপর দ্বিতীয় পি সি সরকার! লোকে ভুল বুঝবেন। ভাববেন, যে পি সি সরকার গত বছর পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন, এবার তিনি ‘দ্বিতীয়’ হয়েছেন। ভাবতে তো আর বিদ্যা- বুদ্ধির লাইসেন্স লাগে না। এমনিতেই বাঙালি, অন্য কারুর অধঃপতনের সংবাদ শুনতে ভালোবাসে। সমবেদনার আড়ালে থাকে আত্মতৃপ্তি। এবারও ভালোবেসে আনন্দে তাই ভাববেন। কিন্তু কতো কিছুই যে আমরা জেনেও জানিনা, তার স্যাম্পল দেখলে অবাক লাগে। আমাদের বহুল আলোচিত , শ্রদ্ধেয় প্রাক্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট “বারাক ওবামা” মহাশয়ের পুরো নাম, ” বারাক ওবামা, জুনিয়র “, বা “মার্টিন লুথার কিং”এর পুরো নাম “মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র”; ” ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা জুনিয়র, স্যামি ডেভিস জুনিয়র…এসব কিন্তু আমরা জেনেও জানিনা। না জেনে তর্ক করাটা আমাদের ভ্রান্তি-বিলাস। আমার মুখের ওপরেই আমাকে খাটো করে বলে আনন্দ পেতে শুনেছি, ” আপনার বাবার ‘শো’ দেখেছিলাম সেই 1978-এ, মহাজাতি সদনে!!! আমি তখন সবে কলকাতায় ধুবড়ী থেকে বদলি হয়ে এসেছি। ..আ-হা-হা সে কী সুন্দর সে সব খেলা, কী সুন্দর ‘ডেলিভারি’.. উঃফ্ !! অতুলনীয়।….খারাপ পাইবেন না…অমনটা আপনার দ্বারা হবে না। ”
আমি মেনে নিই।বলি,” হেঃ হে, কার বাবা, দেখতে হবে তো।”
ভদ্রলোক কষ্ট পান। কেসটা ঠিক জোমলো না দেখে । ক্ষমা-ঘেন্না মিশ্রিত দৃষ্টি দেন।
আমি নির্বিকার।
ভদ্রলোক আমার নিজের বাবারই তো প্রশংসা করছেন। এ তো ভালো কথা। স্বভাবের বশে সময়ের হিসেবটা খালি একটু এদিক ওদিক করে ফেলেছেন। এটা হয়েই থাকে। মেনে নেওয়া যায়।

উনি জানেন না, বাবা জীবনে কখনও মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখান নি। এক দিনও না। বাবা কলকাতায় শো করতেন ‘নিউ এম্পায়ার’ থিয়েটারে, উত্তর কলকাতার ছায়া সিনেমায়, আর কয়েক সপ্তাহ গ্লোব সিনেমায়। ! আর শুধু তা নয়, বাবা জাপানে 1971- এ মারা গেছেন। ওই 1978-এ মহাজাতি সদনে শোগুলো করেছিলাম আমি! পি সি সরকার জুনিয়র। একটানা সাড়ে সাত মাস ধরে, প্রত্যহ। উনি আমার শো এবং আমাকেই দেখেছিলেন। তর্ক করিনি। গুরুজনদের সঙ্গে করতে নেই।

@@@@@@ @@@@@@

আগে বহুবার, বহু জায়গায় বলেছি, ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিলো ,আমার দুটো বাবা। দুজন একদম আলাদা আলাদা মানুষ। একটা হচ্ছেন বাড়ির বাবা, আর অন্যজন হচ্ছেন, আমার স্টেজের বাবা। দুজনে যে একই ব্যক্তি, সেটা জানতাম না। আর তাছাড়া, একই ব্যক্তি বলে ভাবতে যাবো কেন! কোন যুক্তিতে? দুজনের মধ্যে এতো ফারাক, এতো ভিন্ন চরিত্রের , যে আমি ভাবতেও পারতাম না। এখন, এই পিতৃহীন অবস্থায় পঞ্চাশ বছর কেটে যাবার পরও ভাবি, কোনটা ছিলেন আমার ‘আসল’ বাবা!? সেটা ঠিকমতো জানতে পারিনি। । হয়তো ঠিকমতো ব্যালেন্স করে হিসেব করে উঠতে পারিনি, কোন দিকটার কেন ওজন বেশি। ঘটনা বুঝে পাল্টায় তো।
সেই কত্তোবছর আগের কথা। বাবা আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে গেছেন কলেজ স্ট্রিটে, ‘RADU’ কোম্পানীর জুতোর দোকানে, নিজের এবং আমাদের তিন ভাই এর জন্য “Master’s Shoe” , নামে, “স্পেশাল সোফিস্টিকেটেড” ভদ্র জুতো কিনতে। আমরা তটস্থ। একটু এদিক ওদিক হলেই কটমটে লাল রক্তচক্ষু। একদম ‘লেজার বিম!! যেন ভষ্ম করে দেবেন। কেনা তো হলো, কিন্তু এবার শুরু হলো পরীক্ষা। নতুন জুতো পায়ে দিয়েই ফিরতে হবে। একটু হেটে, এদিক-ওদিকে ব্যথায় ফোস্কা পড়েছে। কিন্তু ল্যাংচালেই দোষ। বাবার চাপা হুঙ্কার। “কেনার সময় দেখে নাওনি কেন?”
কে বোঝাবে যে বাবার ওই গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কারোও বাপের সাধ্যি নেই (sorry), ক্ষমতা নেই যে বলবো, “টাইট লাগছে” ! সময় সংক্ষেপ করার জন্য বলতাম “ঠিক আছে”। দোকানদারও দিলদার লোক। বলেন, একদিন দুদিন পড়ে চলাফেরা করলেই সেট হয়ে যাবে। আমরা ঘাড় 45°কাত করে সায় দিই। সুতরাং পি সি সরকার উইথ তিনটে টেম্পুরারি ‘ল্যাংড়া’ ছেলে বকুনি খেতে খেতে নিউ মার্কেটে পূজোর বাজার পরিক্রমা করছেন ব্যাপারটা কালে-ভদ্রে হলেও, বাস্তবে দেখা যেতো। শেষ পর্য্যন্ত, নিউ মার্কেট ফেল করতো। আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য বাবার মন-পসন্দ দোকান ছিলো, গড়িয়াহাট মোড়ের ‘স্টাইলো’ নামের দোকানটা। মালিক ভবতোষবাবু, বাবার পুরোনো বন্ধু। এ খেলা চলতো যতবারই আমরা বাবার সঙ্গে জামাকাপড় কিনতে গেছি, ততবার।তিন ভাই-এরই এক পোষাক। সাদা হাফ শার্ট আর বেশ ঢোলা সাইজের খাঁকি হাফ প্যান্ট। কেনই বা নিউ মার্কেট যাওয়া, বিভিন্ন রঙের জামা-কাপড় দেখা, দর-দস্তুর করা এবং লেংচিয়ে নিউ মার্কেট প্রদক্ষিণ করা, তা ঠিক বুঝে উঠতাম না।
কালে-ভদ্রে ,মা আর বাবা যখন একসাথে দোকানে যেতেন, তখন আমি বোকার মতো কান্না জুড়ে দিতাম। আমিও যাবো। লেংচিয়েই না হয় যাবো। আটকাতেন আমাদের ঠাকুমা। বলতেন কি একটা দরকারী কাজের জন্য আমার নাকি বাড়িতে থেকে ঠাকুমাকে সাহায্য করার প্রয়োজন। কাজটা কি, তা কিন্তু এ-জীবনেও জানা হয়নি। মা আমাদের পড়ার ঘরের মেঝেতে একটু জল ঢেলে বলতেন, “এটা শুকোবার আগেই আমি ফিরে আসবো। প্রমিজ।”

ঠাকুমার কাছে বসেই শুনতাম গাড়ির আওয়াজ। আমি দৌড়ে বারান্দায় আসতাম। গাড়ি ততক্ষণে ‘নেই’ হয়ে গেছে। জল শুকোতে দেখতে পড়ার ঘরে আসতাম। ঠাকুমার কাছেও যেতাম, আবার জলের কাছে আসতাম, পাশে বসে ফুঁ দিতাম। একটু পরে ঠাকুমার কাছে যেতাম, দরকারী কাজে সাহায্য করতে। ঠাকুমা, ভূমিকা করতে করতেই সময় নষ্ট করতেন। দৌড়ে আসতাম আবার জলের কাছে। মেঝেতে শুয়ে ফুঁ দিতে দিতে, কখন যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়তাম… ঘুম থেকে উঠে দেখি, বিছানায় শুয়ে আছি। মা আমাকে তুলে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছেন। জলের খবরটা আর নিতাম না। ঠাকুমা এসে কমপ্লেন করতেন, “তুমি তো ঘুমিয়েই পরলে। তাই আমি একা একাই কাজটা করে নিয়েছি।” ভীষণ বোকা ছিলাম। এখনোও আছি।ভালো আছি। চালাক হতে ঘেন্না করে। চোখের জলকে শাসন করি। আমার গাল ভেজাবি না। শুকনো থাক। পারলে উবে যা। দাগ রেখে উবে যায়।

এহেন বাবার কাছ থেকে ম্যাজিক শিখলাম কি করে? সেটাই বিরাট প্রশ্ন। একদিন দেখলাম, বাবা খুব মুডে আছেন। খুব মোলায়েম করে নখ খুঁটতে খু্ঁটতে কথাটা তুলি। বলি, “বাবা, আমার না..ইয়ে, মানে খুব ম্যাজিক দেখাতে ইচ্ছে করে…শিখিয়ে দেবে?” জবাবে বাবা হেসে হেসে একটা ধাঁধাঁলো কথা বলেন। “ম্যাজিক কখনও কাউকে শিখিয়ে দেওয়া যায় না। ম্যাজিক শিখে নিতে হয়। ”
শুনেই আমার দম ফুরিয়ে যায়। একটু পরেই মিউ মিউ করে বলি, ” শিখতে গেলে কী দরকার হয়?” বাবা সেই একই রকম নির্বিকার ভাবে হেসে বলেন, -“পেটে বিদ্যে থাকার প্রয়োজন হয়। ”
আমি চুপসে যাই, কিন্তু ভেঙ্গে পরিনি। আমি যে তখন আড়াল থেকে, (এক বিশেষ জায়গা থেকে) বাবার ওপর প্রতিনিয়ত ‘নজর’ রাখছি, বাবার কর্মপদ্ধতি, ইত্যাদিতে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে অনেক কিছু শিখে নিয়েছি, নিচ্ছি , একা একা ‘বাবা-বাবা’খেলি, তা এই ‘বাবা’ নামক গম্ভীর ব্যাক্তিটি, বা আপনাদের -জাদু সম্রাট পি সি সরকার নামক, “বিশ্বের সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ঠ মঞ্চ-মায়াবী”র সম্পূর্ণ অগোচরে ছিলো। প্রতিদিনই আমি তাঁকে দেখে শিখছি। দ্রোণাচার্যের কছে একলব্যের শিক্ষালাভ করার মতো গুরুর অগোচরেই শিখছি, তা আমার গুরু জানতেন না। ঋক্ বেদ-এ লেখা আছে, “অহমিদ্ধি পিতুষ্পরি মেধামৃতস্য জগ্রভ।।”(Vlll. 6.10) অর্থাৎ, আমি যা শিখেছি, তা আমি আমার বাবার কাছে শিখেছি। আমিও ঠিক তাই। যা শিখেছি, তার স—ব, আমি আমার বাবার কাছে শিখেছি। কিন্তু তখনও পর্যন্ত উনি আমায় নিজে হাতে ধরে একটুও শেখান নি। আমারও গুরুদক্ষিণা দেওয়া হয়নি। বাকী রয়ে গেছে। জাদুর ডুগডুগি ডমরুর আওয়াজ আর ডাকাতিয়া বাঁশীর সুর বাজছে আমার কানে। পাওনাদার চলে গেছেন। কিন্তু আমারও তো বেলা যায়। কি যে করি। বুঝি দূর দেশের ‘সেই’ রাখাল ছেলেটার মতো গুরু দক্ষিণা তো দূরের কথা, বিদ্যেটার দামই দেবার মুরোদ আমারও নেই। সে বাঁশীটাকেই তার রেখে দিয়ে গেছিলো। আমিও না হয় পুরো বিদ্যেটাকেই রেখে দিয়ে যাবো।

 

তারপর একদিন, যখন আমি সবে B. Sc. পাশ করে হাতে রেজাল্ট পেয়েছি।আমি গর্বের সঙ্গে সেই মার্ক-শিট বাবাকে দেখিয়ে বলি, ” আমি পাশ করেছি, সাইন্স্ গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, এবার তো ম্যাজিক করতে পারি? ”
বাবা কথাটাকে পাত্তাই দিলেন না। বললেন, “ম্যাজিক করতে গেলে, বিজ্ঞানতো জানতেই হবে, এ আবার নতুন কথা কি? কিন্তু ম্যাজিক তো মূলতঃ হচ্ছে আর্ট। আর্টের সর্বশেষ পরিণতি। তুমি যদি ইমোশন না বুঝে শুধু কায়দা বা বিজ্ঞান এবং রেওয়াজের ওপর নির্ভর করো, তাহলে সেটা সার্কাস বা জাগলারি বা যন্ত্রের কেরামতি দেখানোর উদাহরণ হয়ে যাবে। আর্ট হবে না। তোমাকে দৃশ্য-সাহিত্যে ডুবে অরূপের খোঁজে থাকতেই হবে। রূপকথাকে বাস্তবে ঘটিয়ে দেখাতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন ‘জাদু’রস, সাহিত্যের অলীক-জগৎ সৃষ্টি করতে পারে। ”

আমি মা’র কাছে এসে ফুঁশতে শুরু করি। মা আমাকে বলেন, ” সহজ ব্যাপার। তোমাকে এর জবাবে আর্টস্ নিয়ে পড়তে হবে। সম্ভব হলে আবার B. A.পাশ করেও দেখাতে হবে। ওটাও পাশ করে বাবাকে দেখাও। ”
খবর নিলাম। সুখবর। নান্টু ব্যানার্জী নামে এক জার্নালিস্ট বন্ধু খবর দিলো, কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে একবার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট হলে, তারপর স্পেশাল বি. এ. পরীক্ষা প্রাইভেটে দেওয়া যায়। ব্যাস্। মা কে প্রণাম করে পরের ব্যাচেই পরীক্ষায় বসে গেলাম। বইগুলো নিয়ে গল্পের বই-এর মতো পড়ে ছিলাম। জন কীটস্, চার্লস ল্যাম্ব, শেক্সপীয়র, বার্ণার্ড শ, থেকে শুরু করে, কবিগুরু, মাইকেল মধুসূদন দত্ত , মহর্ষি গ্যেটে, মহাকবি ভার্জিল, হিউয়েন চুয়াং, মার্কো পোলো, প্রমূখ সিলেবাসের বাইরের বা ভিতরের, চেনা বা অচেনা সহমর্মীরা নিঃসঙ্কোচে আমার স্বপ্নের সঙ্গী হিসেবে দরজায় টোকা না দিয়েই ঢুকতেন। প্রাণ খুলে আড্ডা মারতেন। পরীক্ষায় বসলাম। ওঁরাই ছিলেন আমার প্রাণসখা। প্রশ্নের ‘উত্তর’ লিখিনি। ওদের কাছে যেন চিঠি লিখে আমার বক্তব্যটা জানিয়েছি।
ব্যাস্, রেজাল্ট হয়েছে ডিস্টিংশন।
ম্যাজিক!
আমি পাশ করেছি!!! …… ও মা, খুব ভালো নম্বরও পেয়েছি!!!!পেরেছি।

দুখানা ডিগ্রী নিয়ে, বাবার সামনে হাজির হই। “আমি সায়েন্স নিয়েও গ্র্যাজুয়েট, আর্টস্ নিয়েও গ্র্যাজুয়েট, এবার তো ম্যাজিক শুরু করতে পারি? ”
বাবা যে এতো কঠিন মানুষ জানতাম না।
ক্রমশঃ। To be continued as (পর্ব-060)

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.