জন্মদিনে স্মরণ : মু ন্সি প্রে ম চ ন্দ
বাবলু ভট্টাচার্য : বহামীরপুর জেলার শিক্ষা বিভাগের সাব-ডেপুটি ইন্সপেক্টর তখন তিনি। আটপৌরে সরকারি চাকুরে, কিন্তু তার আড়ালেই লুকিয়ে আছে অন্য আরেক পরিচয়। উর্দু আর ফার্সি শিখেছিলেন ছেলেবেলাতেই। গল্প লেখার শুরুও বেশ কম বয়স থেকেই। ১৯০৭ সালে উর্দু ভাষায় প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘সোজ-এ-ওঅতন’
(দেশ মায়ের বিষাদ গান)।
বইটি প্রকাশ পেয়েছিল ‘নবাব রায়’ নামে। পরাধীন দেশের পটভূমিকায় এই গল্পগুলো ছিল ছাইচাপা আগুনের মতো। তীব্রভাবে রাজনৈতিক বার্তাবহ। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ সরকারের বিষচক্ষু পড়ে সেই বইয়ের উপর। সরকারি হুকুমে বইটি বাজেয়াপ্ত হয়।
এই ঘটনার পর ‘নবাব রায়’ নামে আর একটাও বই লেখেননি তিনি। কিন্তু ব্রিটিশ রক্তচক্ষু তাঁর লেখা বন্ধ করতে পারেনি কখনও। নবাব রায় হারিয়ে গেলেও ফিনিক্স পাখির মতো তার ছাই থেকে জন্ম নিল নতুন নাম, নতুন পরিচয়- মুন্সি প্রেমচন্দ।
তাঁর বাবা আজায়ব রায় ছিলেন পোস্ট অফিসের সামান্য কেরানি। মা আনন্দী দেবী। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল ধনপত রায় শ্রীবাস্তব। কাকা নাম রাখেন নবাব রায়। পরে ‘মুন্সি প্রেমচন্দ’ ছদ্মনাম নিয়ে সাহিত্য জগতে প্রবেশ, সেই নামেই আজও হিন্দি সাহিত্যের ধারায় সমধিক পরিচিত তিনি।

মাত্র আট বছর বয়সে মা’কে হারান প্রেমচন্দ। দিদিমার আদরে প্রশ্রয়ে বড় হলেও বছর কয়েক পর মারা যান দিদিমাও। একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু আর নিঃসঙ্গতা ছেলেবেলা থেকেই তাড়া করে বেড়াত তাঁকে। এর কিছুদিনের মধ্যেই বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়, আর বাবাও ব্যস্ত হয়ে পড়েন চাকরি নিয়ে। ফলে পরিবারের সঙ্গে একটা বড় রকমের দূরত্ব তৈরি হয় প্রেমচন্দের।
মায়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর বাবা আবার বিয়ে করেন বটে, কিন্তু বিমাতার কাছ থেকে কিশোর বয়সে তেমন ভালোবাসা পাননি। সেভাবে অন্তরের যোগ গড়ে ওঠেনি ঠিকই, তবু তাঁর সাহিত্যে ফিরে ফিরে এসেছে ছদ্ম রুক্ষতার আড়ালে এদেশের স্নেহশীল সৎ মায়েরা।
লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিলেন ছেলেবেলা থেকেই। খুব ছোটবেলায় মাদ্রাসায় পড়াশোনার সূত্রে শিখে ফেলেছিলেন উর্দু আর ফার্সি দুটো ভাষা। আরেকটু বড় হয়ে একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়ে শিখে ফেললেন ইংরিজিও। এই ভাষাশিক্ষার পথ ধরেই পাশ্চাত্য সাহিত্যের সুদূর দিগন্ত খুলে যায় তাঁর সামনে।
কানপুরে ‘জমানা’ পত্রিকার সম্পাদক দয়া নারায়ণ নিগমের কথা মতো নবাব রায়ের বদলে ‘মুন্সি প্রেমচাঁদ’ নামে লেখা শুরু করেন ধনপত। ১৯১৮ সালে প্রেমচন্দ ছদ্মনামেই প্রকাশ পেল ‘সেবাসদন’। এই উপন্যাসই হিন্দি সাহিত্যে স্থায়ী আসন দেয় তাঁকে। এর পর একে একে প্রকাশ পায় ‘প্রেমাশ্রম’, ‘রঙ্গভূমি’, ‘কায়া-কল্প’, ‘নির্মলা’, ‘গবন’, কর্ম-ভূমি, ‘গো-দান’-এর মতো উপন্যাস।

পাশাপাশি ছোটগল্পকার হিসাবেও যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন প্রেমচন্দ। সারাজীবনে তিনশোর বেশি গল্প লিখেছেন প্রেমচন্দ। বেশিরভাগ গল্পেই আঁকা রয়েছে খেটে খাওয়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের জীবন যন্ত্রণার করুণ ছবি।
পাশাপাশি ‘সংগ্রাম’, ‘কর্বলা’, ‘তজুর্বা’র মতো বেশ কিছু নাটকও লিখেছিলেন প্রেমচন্দ। তবে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসাবে তিনি যতটা সফল্য অর্জন করতে পেরেছিলেন নাট্যকার হিসাবে ততটা সাফল্য পাননি।
শিবরানি নামে এক বিধবাকে বিয়ে করেন প্রেমচন্দ। বিধবাবিবাহ সেসময় এক বিতর্কিত ও জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যা ছিল। এই বিয়ের জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছে প্রেমচন্দকে। তাঁকে কী তীব্র সামাজিক দ্রোহের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেসময়, তার জীবন্ত ছাপ ফুটে উঠেছে তাঁর ‘প্রেমা’ উপন্যাসে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ১৯২০ সালে গান্ধিজির সঙ্গে প্রেমচন্দের সাক্ষাৎ হয় গোরখপুরে। এর প্রতিক্রিয়ায় গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে প্রেমচন্দ তাঁর কুড়ি বছরের সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেন।
তাঁকে বলা হত হিন্দি সাহিত্যের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দেশের নানা প্রান্তে নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যকর্ম।
১৯৩৬ সালের ৮ অক্টোবর মৃত্যু হয় হিন্দি ভাষার এই পুরোধা কথাসাহিত্যিকের।
মুন্সি প্রেমচন্দ ১৮৮০ সালের আজকের দিনে (৩১ জুলাই) উত্তর প্রদেশের বারাণসীর নিকটবর্তী লমহী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।



















Be First to Comment