Press "Enter" to skip to content

চ্যাপলিন-শিষ্য জহরের প্রধান অস্ত্র ছিল শরীরী অভিনয়….।

Last updated on September 20, 2022

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ জ হ র রা য়

বাবলু ভট্টাচার্য : হলিউডি সিনেমায় যেমন লরেল-হার্ডি জুটি মাতিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই টলিউডে ভানু-জহর জুটি। লীলা মজুমদার বলেছিলেন রঙ্গরস করতে গেলে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। জহর রায় সেই দর্শনটাই আত্মস্থ করেছিলেন।

দু-তিন সিনের সামান্য সুযোগেই তিনি আলো কেড়ে নিতে পারতেন। সামান্য সংলাপকে বাড়িয়ে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারতেন। তাঁর আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুটি ছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই তুমুল জনপ্রিয়।

জহর কিন্তু ফিল্মি বাড়িরই ছেলে। বাবা সতু রায় ছিলেন নির্বাক যুগের নামকরা অভিনেতা। কিন্তু তাতে জহরের বিশেষ সুবিধে হয়নি।

জহরের জন্ম বরিশালে। বাবা পরে চলে আসেন কলকাতায়। শেষে চাকরি সূত্রে স্ত্রী আশালতাকে নিয়ে পটনায় গিয়ে থিতু হন। সেখানেই জহরের অনেকখানি বেড়ে ওঠা। প্রথম অ্যামেচার থিয়েটারে অভিনয়ও।

ততদিনে তিনি গুরু মেনেছেন এক সাহেবকে। বয়সে বছর কুড়ির বড়। নাম চার্লস চ্যাপলিন। জহরের স্কুলবেলা ফুরনোর আগেই হয়ে গিয়েছে ‘দ্য কিড’, ‘দ্য গোল্ড রাশ’, ‘দ্য সার্কাস’, ‘সিটি লাইটস’। ‘মডার্ন টাইমস’, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ আসছে— তখন তিনি সদ্য তরুণ। ‘পাগলের মতো চ্যাপলিনের ছবি দেখতাম। এক-একটা ছবি আট বার দশ বার করে। তাঁর অভিনয়ের প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি মুভমেন্ট গুলে গুলে খেতাম’— বলেছেন জহর।

কিন্তু কোথায় রুপোলি পর্দার স্বপ্ন! বিএ পড়ছিলেন বিএন কলেজে, সংসারের চাপে ফোর্থ ইয়ারে পড়া ছেড়ে ঢুকতে হল চাকরিতে। পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রুফ রিডার। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালসে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। শেষমেশ তা-ও ছেড়ে দর্জির দোকান দিলেন। দিব্যি চলছিল। কারিগরের থেকে সেলাই মেশিন চালাতে, এমনকী শার্ট-প্যান্ট কাটতেও শিখে নিয়েছিলেন জহর।

‘কিন্তু সব গোলমাল করে দিলেন ওই চ্যাপলিন সাহেব’, বলছেন জহর— ‘এক দিন দোকান-টোকান তুলে দিয়ে কলকাতায় চলে এলাম।’ ট্যাঁকে কড়ি নেই। একটা বরযাত্রীর দলে ভিড়ে ট্রেনে চেপে চলে এলেন। খুঁটি বলতে পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, জহরের ‘কালাচাঁদদা’। তিনিও তদানীন্তন বিহারের লোক, ভাগলপুরের।

তখন দেশভাগ হব-হব করছে। কলকাতা অশান্ত। অর্ধেন্দু ‘পূর্বরাগ’ করার তোড়জোড় করছেন। জহর হাজির। অর্ধেন্দু দেখে নিতে চাইলেন, ছেলেটা কতটা কী পারে। চ্যাপলিন হয়ে উঠে জহর শুরু করে দিলেন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। মিলে গেল রোল। তবে ‘পূ্র্বরাগ’ নয়, সম্ভবত সুশীল মজুমদারের ‘সাহারা’ ছবিতে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান জহর। এর পর বিমল রায়ের ‘অঞ্জনগড়’।

ঘটনাচক্রে, ওই সময়েই ‘জাগরণ’ ছবিতে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন বিক্রমপুরের এক বাঙাল, এর পর প্রায় সারা জীবন যিনি জহরের সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে জুড়ে যাবেন— ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু পর্দায় নয়, পর্দার বাইরেও ভারী ভাব দু’জনে। এ ওর ‘ভেনো’ আর ‘জহুরে’। দর্শক ওঁদের দেখলেই হেসে কুটোপাটি। তাই পরিচালকেরা ওঁদের গুঁজে দেন যেখানে-সেখানে দু’চার সিনে।

দুই বন্ধুই এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। সরাসরি তাঁদের নামেই ছবি হয়েছে— ‘ভানু পেলো লটারী’, ‘এ জহর সে জহর নয়’ আর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিষ্ট্যান্ট’। মজার কথা, এর মধ্যে যেটিতে জহরের নাম নেই, সেটিও আদ্যন্ত জহরময়।

ভানুর মতে, ‘ওর যেটা সব চাইতে বড় গুণ ছিল সেটা হচ্ছে ফিজিক্যাল ফিটনেস। নাকের ওপর একটা ঘুষি মারলে… জহর সমস্ত শরীরটা ঠেলে দিয়ে এমনভাবে পড়ে যেত যে সেটা কিছুতেই অভিনয় বলে মনে হত না।’ চ্যাপলিন-শিষ্য জহরের প্রধান অস্ত্র ছিল শরীরী অভিনয়।

বরং এই রাশি-রাশি হাসির বাইরে এমন কিছু চরিত্র জহর পেয়েছেন এবং করেছেন, যা তাঁকে অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়েছে। কে ভুলবে ‘বাঘিনী’ ছবির শুরুতেই সেই চোলাই ঠেকের মালিককে? যে কিনা পুলিশের তাড়া খেয়ে পালায়, মা মরা মেয়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে, তার পর পায়ে পেরেক বিঁধে সেপটিক হয়ে মরে। উৎপল দত্তের আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক ছবি ‘ঘুম ভাঙার গান’-এ যে কী অন্য পরতের অভিনয় তাঁর!

তরুণ মজুমদারের মতে, “ওঁর গায়ে কমেডিয়ানের তকমা জুড়ে দেওয়া অনুচিত।’’ ‘পলাতক’, ‘একটুকু বাসা’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘ঠগিনী’ ছবিতে জহরকে নিয়েছিলেন তিনি। ‘পলাতক’-এ জহরের অভিনয় নিয়ে আজও তিনি উচ্ছ্বসিত।

সত্যজিৎ প্রথমে ‘পরশপাথর’ ছবিতে ছোট্ট রোল দিয়েছিলেন, পরেশ দত্তের চাকর ভজহরি। দশ বছর পরে হাল্লার মন্ত্রী। ঋত্বিক ঘটকও তাই। প্রথমে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে কনস্টেবলের এক চিলতে রোল। সাত বছর বাদে ‘সুবর্ণরেখা’র অনেকখানি জুড়ে ফাউন্ড্রি ওয়র্কশপের ফোরম্যান মুখুজ্জে। নিয়েছিলেন ‘বগলার বঙ্গদর্শন’-এও, ছবি শেষ হয়নি। শেষে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’য় গেঁয়ো মাতালের তুচ্ছ চরিত্রে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া জহর।

সুশীল মুখোপাধ্যায়ও লিখেছেন, ১৯৬১ সালে তাঁর ‘অনর্থ’ নাটকে খলনায়কের চরিত্রে কী অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন জহর! গোড়ায় তিনি স্টেজে ঢুকলেই দর্শক হাসতে শুরু করত। কিন্তু পরে তারা বুঝে যায়, এ অন্য জহর। তৃতীয় দৃশ্যে যখন ভিলেনি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়, তার সমতুল্য অভিনয় সে সময়ের মঞ্চে হয়নি, দাবি সুশীলের।

আসলে সিনেমার বাইরেও তিন-চার রকমের জহর ছিলেন। নাটকের জহর, কৌতুকের জহর, পড়ুয়া জহর আর ২১/১ রাধানাথ মল্লিক লেনের জহর।

টালিগঞ্জে সকলেই জানত, কারও সঙ্গে ঝঞ্ঝাটে জহর নেই। কিন্তু সেই জহরই রুখে দাঁড়ালেন যখন রঙমহল থিয়েটার বন্ধ হতে বসেছে। শিল্পীদের নিয়ে দিনের পর দিন বসে থাকলেন রাস্তায়। পরে সকলকে নিয়ে রঙমহল কার্যত তিনিই চালিয়েছেন।

এই মহান শিল্পী ১১ আগস্ট ১৯৭৭, ৫৭ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

জহর রায় ১৯১৯ সালের আজকের দিনে (১৯ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন।

More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *