স্মরণ : মোহাম্মদ রফি
বাবলু ভট্টাচার্য : উপমহাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মোহাম্মদ রফি। ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে একসময় সমগ্র উপমহাদেশে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন তিনি ছাব্বিশ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্য গায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মোহাম্মদ রফি।
সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক এবং ৬ বার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি বহুবিধ গানে অংশ নেয়ার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালবাসা, কাওয়ালী, ভজন, গজল-সহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শীতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে হিন্দী এবং উর্দু ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তার গানগুলোতে বৈচিত্র্যতা এসেছে সমধিক।
ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব এলাকার অমৃতসর গ্রামের সুলতান সিংয়ের অধিবাসী হাজী আলী মোহাম্মদের ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ রফি। মোহাম্মদ রফি তার নিজ গ্রামে এক ফকিরের ভজন গানকে অনুকরণ করে গান গাওয়া শুরু করেন। জীবিকার সন্ধানে তার বাবা হাজী আলী মোহাম্মদ ১৯২০ সালে লাহোরে চলে যান এবং ভাট্টি গেটের নূর মহল্লায় একটি স্যালুনের মালিক হন।
১৩ বছর বয়সে রফি লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে. এল. সাইগলের (কুন্দনলাল সায়গল) সাথে জীবনের প্রথম দর্শক-শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে কনসার্টে গান পরিবেশন করেন। ১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের পরিচালনায় ‘গুল বালোচ’ ছবির মাধ্যমে সঙ্গীতে পেশাগতভাবে অভিষেক ঘটান রফি। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র ‘গাও কি গৌরী’ ছবিতে নেপথ্য গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটান।
১৯৪৪ সালে মোহাম্মদ রফি বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসেন। সেখানে তিনি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবনলাল দত্ত এবং ফিরোজ নিজামী’র মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন।
শিল্পী মোহাম্মদ রফি হিন্দীসহ কোনকানি, উর্দু, ভোজপুরী, উড়িয়া, পাঞ্জাবী, বাংলা, মারাঠী, সিন্ধী, কানাড়া, গুজরাটি, তেলেগু, মাঘী, মৈথিলী, অহমীয়া ইত্যাদি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন। এছাড়াও তিনি গান গেয়েছেন- ইংরেজী, ফার্সী, স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষায়।
১৯৪৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শাহজাহান’ চলচ্চিত্রে কুন্দনলাল সায়গলের সাথে মেরে স্বপ্ন কি রানি, রুহী রুহী নামের কোরাসে অংশ নেন। মেহবুব খানের ‘আনমল ঘড়ি’ (১৯৪৬)-তে ‘তেরা খিলোনা তোতা বালক’ এবং ‘জুগনু’ (১৯৪৭) চলচ্চিত্রে ‘ইয়াহান বাদলা ওয়াফা কা’ গানে নূর জাহানের সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন।
নওশাদের দিক-নির্দেশনায় সর্বমোট ১৪৯টি সঙ্গীত পরিবেশন করেন মোহাম্মদ রফি। তার মধ্যে একক সঙ্গীত ছিল ৮১টি। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী নিহত হবার পর হুসনলাল ভগতরাম-রাজেন্দ্র কৃষাণ-রফি ত্রয়ী একরাত্রিতেই কালজয়ী শুনো শুনো এই দুনিয়াওয়ালো, বাপুজী কি অমর কাহিনী গান রচনা করে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপর তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহ্রু’র আমন্ত্রণে গানটি পুণরায় পরিবেশন করে উপস্থিত সকলকে শোনান।
১৯৬৫ সালে সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে মোহাম্মদ রফি লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলাল, মদনমোহন, আর.ডি.বর্মণ এবং এস.ডি.বর্মণের ন্যায় জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালকদের গানে কণ্ঠ দেন।
১৯৭৭ সালে হাম কিসি সে কাম নেহি শিরোনামের হিন্দী চলচ্চিত্রে রাহুল দেব বর্মনের সঙ্গীত রচনায় ‘ক্যায়া হুয়া তেরা ওয়াদা’ গানের জন্য ভারতের জাতীয় পদক এবং ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন।
শুরুর দিকে ফিল্মফেয়ার কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র একজন কণ্ঠশিল্পীকে বছরের সেরা গায়ক নির্বাচিত করতো। ষাটের দশকে কিশোর কুমারকে টপকিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশী (৬বার) এ পদক পেয়ে শীর্ষস্থানে ছিলেন।
মোহাম্মদ রফি ১৯৮০ সালের আজকের দিনে (৩১ জুলাই) মুম্বাইতে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment