**আজ গুড ফ্রাইডে**
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৫ এপ্রিল ২০২২। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতে নবরাত্রি, চড়ক,বাংলা নববর্ষ ও রমজান মাসের আবহে এবার হারিয়ে গেল খৃষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের ইস্টার উৎসব। যা চারদিনব্যাপী পালিত হয়। গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে, ইস্টার সানডে ও ইস্টার মান ডে নামে। এই প্রতিবেদনে দুটি তথ্য খুঁজে দেখবো, সত্যিই কি এই দিনে যীশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন? আদপেই কি এই পরব যীশুর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে শোক পর্ব? নাকি অতীতে দুর্গাপুজোর মতোই চারদিনব্যাপী ঋতু উৎসব? শস্যদেবীর আরাধনা? ইতিহাস কি বলছে?
শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে বিশ্বজুড়েই পালিত হয় ইস্টার উৎসব। খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসীদের বাইবেলের নবতম অংশ নিউ টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে, মতভেদের কারণেই দেশের রাজা ও পুরোহিতেরা পরম পিতা ঈশ্বরের প্রিয় পুত্র যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে। যীশুর শিষ্যরা প্রভু যীশুর মৃতদেহ কবরস্থ করেন এক পাহাড়ি গুহায়। তিনদিন পর অলৌকিক উপায়ে যীশু কবর ছেড়ে উঠে শ্বেতশুভ্র পোশাকে দুহাত তুলে আকাশে তাকালে পরম পিতা তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান। এখন থেকেই বিতর্ক শুরু। যীশু তো রাজার রাজত্ব কেড়ে নিতে চাননি। বিদ্রোহও করেননি। তিনি তো পরম পিতা ঈশ্বরের এক নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করেছিলেন। যে মতবাদ মানবপ্রেম। তবে কেন রাজা ও পুরোহিতদের চোখের বালি হলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জানতে হবে সেই সময়ের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। পিছিয়ে যেতে হবে ২০২২ বছর আগে। যীশুর জন্ম বেথলেহেম নগরে। যীশুর জন্মের আগে থেকেই প্যালেস্টাইন ও জেরুজালেম ছিল ইহুদি জাতি অধ্যুষিত। যীশু নিজেও ছিলেন ইহুদি। ইহুদি কারা? বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট বলছে, পৃথিবীর প্রথম নারী ,পুরুষ আদম ও ইভ। (যদিও প্রথম নারী ইভ নন। সে অন্য এক গল্প।) । এই আদমের বংশধর মুসা। মুসা খ্রিস্টপূর্ব ১৩৯৯ অব্দে ইসরায়েলি বংশে ইমরানের ঔরসে ও জোচিবেদের গর্ভে জন্মান। পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত হিসেবে ইহুদি ধর্মের প্রবর্তন করেন। ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকুব। ইয়াকুবের ১২টি পুত্রের নামে ১২টি গোষ্ঠী তৈরি হয়। এই গোষ্ঠীর একটিতে জন্ম নেন মহামানব ইয়েশুয়া। ইনিই বাংলায় যীশু ও ইউরোপে জেসাস নামে পরিচিত হন অনেক পরে।
সাধারণত ধারণা, যীশুর মাতৃভাষা হিব্রু। আসলে তাঁর ভাষা ছিল আর্মাইক। উচ্চারণ ভেদে আর্মাইচ। যীশু সেমেটিক ধর্মের ত্রুটি খুঁজে সঠিক পথে মানুষকে চালিত করতে চেয়েছিলেন। অমত ছিল রাজা ও পুরোহিতেরা। সেই সময়ে ইহুদি দেবতা ছিলেন জেহবা। সেই ঈশ্বরের বার্তাবাহক ছিলেন মৌজেস। সেখানে যীশুকে মানবেন কেন? ফলে যীশু হলেন চক্ষুশূল। যীশুর জন্মকাল নিয়েও বিতর্ক আছে। আজকের হিসেবে ২০২২সাল আগে যীশুর জন্ম। কিন্তু যীশুর জীবনী লেখক রেঁনা বলেন, সম্রাট অগাস্টাস সিজারের রাজত্বকাল ৭৫০ রোমান অব্দে। হিসেবটা ছিল ভুল। ঐতিহাসিক সায়মন সেবাগমন্টে ফিউরির বক্তব্য, যীশুর জন্ম হয়েছে আরও চার বছর আগে। আবার ঐতিহাসিক আইজ্যাক আসিমভ বলেছেন, যীশুর জন্ম আরও আগে। ড: এস পি জে স্টুয়ার্ড এর মতে, যীশুর জন্মের হিসেবে এখন ২০২৮ সাল। ভারতীয় জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির লিখেছেন খ্রিস্টপূর্বের ১২অব্দের ২৬অক্টোবর যীশু জন্মান। সেহিসেবে এখন ২০৩২ সাল।
ফিরে যাই যীশুর মৃত্যু প্রসঙ্গে। যীশু তখন কৈশোরে। রাজা হেরোদ মারা যান। যীশু ভেবেছিলেন, তাঁর বিরোধিতা বোধহয় শেষ হলো। তাই তিনি মা মেরীর সঙ্গে গালিল প্রদেশের নাজারথ নগরে ফিরে এলেন। তারপর যীশু ক্রুশবিদ্ধ হন। শিষ্যরা রাতে রাজপ্রহরীরা ফিরে গেলে যন্ত্রণাকাতর যীশুকে ক্রুশ থেকে নামিয়ে অ্যালোভেরা পাতার রস দিয়ে শুশ্রুষা করে গুহায় লুকিয়ে রাখেন। তিনদিন পর একটু সুস্থ হলে যীশু পালিয়ে ইরান , আফগানিস্থানের পথ ধরে ভারতে আসেন। কেননা বাইবেলে যীশুর ১২ বছর বয়স থেকে ৩০বছর বয়সের কোনও তথ্য নেই। জহরলাল নেহেরু পণ্ডিত ছিলেন। তিনি বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ গ্রন্থে (প্রকাশক, আনন্দবাজার১৯৯২, পৃষ্ঠা ৮২) লেখেন, যীশু তাঁর ১২গোত্রের সদস্যদের নিয়ে লাদাখ, তিব্বত হয়ে কাশ্মীরে থিতু হন। কবিশেখর ভুবন মোহন দাস নেহেরুর বক্তব্য সমর্থন করে লেখেন, যীশু ভারতে এসে বৌদ্ধ সংঘারামে শিক্ষা নিয়ে গৌতম বিশ্বের ধর্মই প্রচার করেন।
২০১৫ তে গোয়া থেকে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা নবহিন্দ টাইমস্ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যীশুর লস্ট ইয়ারস সময়ে তিনি ভারতে চলে আসেন। অনেকে বলেন, ৩০বছর বয়সের পর স্বদেশে যীশু ফিরে যান। কেউ বলেন, তিনি ৪৯ বছর বয়সে কাশ্মীরেই মারা যান। সেখানে যীশুর সমাধি আছে। যীশুর মা , পত্নী ও ভক্তরাও কাশ্মীরে ছিলেন। যীশুর সমাধি যা ‘রোজা বাল মাজার’ নামে খ্যাত তাই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রযোজনায় ‘দি রোজা বাল সিরিন অফ শ্রীনগর’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়। নাজারেথে মা মেরী একবার যীশুর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তখনও নাকি যীশু একবার কাশ্মীরে পালিয়ে এসেছিলেন। যীশুকে নিয়ে এক বই লেখেন আর এস এস সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা গণেশ দামোদর সভারকার। তাঁর দাবি, যীশু বিশ্বকর্মা ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম নেন ভারতে। নাম ছিল কেশারাও কৃষ্ণ। খৃষ্টান ধর্ম তাই হিন্দু ধর্মের এক শাখা।
এবার আমরা দেখি গুড ফ্রাইডে আসলে কি? স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ শ্রী রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ থেকে প্রকাশিত শ্রী দুর্গা গ্রন্থে ৭৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, সূর্য বা অগ্নি পূজা থেকে শস্যাধিষ্ঠাত্রী কেন, সকল দেবদেবীর রূপ ও বিকাশের উৎপত্তি হয়েছে। সিরিয়া,পাশ্চাত্যের গ্রিস সাইপ্রাস, এথেন্স, ক্রিট প্রভৃতি দেশ ও দ্বীপে দুর্গাপূজার মতো corn goddess এর পূজা ও উৎসবের নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। শরৎকালে দুর্গা পূজার মতো পাশ্চাত্যেও ইস্তারাদেবীর উদ্দেশ্যে ইস্টার উৎসব( easter) গোড়াকার দিকে স্যক্সনদের( saxons) ভেতর জার্মানিতে পালন করা হতো, পরে ইংল্যান্ডে, আমেরিকায় ও অপরাপর দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। ইস্তারাদেবী একদিকে অমৃতাধিষ্ঠাত্রী দেবী ( wine goddess) ও অন্যদিকে রণদেবী ( war goddess)। দেবীর দুপাশে সিংহ ও সর্প আছে। সিংহ সূর্যের প্রতীক আর সর্প মেঘ তথা বিদ্যুতালোকের প্রতীক। ইস্তারাদেবীর উৎসব এক সময়ে প্রচলিত ছিল। এই ইস্তারাদেবীর উদ্দেশ্যে বসন্তকালে অর্থাৎ ইংরাজি এপ্রিল বা মার্চ এবং বাংলা চৈত্র ও বৈশাখ মাসে উৎসবের অনুষ্ঠান করা হয় । এখনও ঠিক তাই চলে আসছে। ইস্টার এজন্য বসন্তোৎসব (spring festival) বলে প্রচলিত।
রবার্টসনও বলেছেন, christmas is A solar festival,Easter is also a solar festival. সুতরাং বসন্তকালে বাসন্তী, দুর্গা, শরৎকালে শারদীয়া দুর্গা, যীশুখ্রিস্টের জন্মোৎসব ও ইস্তারোৎসব আসলে একই।,,,, এই ইস্তারাদেবীর উৎসবের আগে গুড ফ্রাইডে উৎসব। গুড ফ্রাইডেও বসন্তকালীন উৎসব। ফ্রিজিয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ফ্রিজিয়া ও ফ্রিগার নামানুসারে ফ্রাইডের নামকরণ হয়েছে।,,,,, মোটকথা, গুড ফ্রাইডে থেকে ইস্টার মান ডে পর্যন্ত খ্রীষ্ট সমাজের চারদিন ধরে যে উৎসব ছিল তা সম্পূর্ণ বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয়। বাসন্তী দুর্গা পুজারও সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী এই চারদিন ধরে অনুষ্ঠান করা হয় । যীশুর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর, না ৬ জানুয়ারি,তেমন জন্মের বছর কিম্বা মৃত্যু নিয়েও ঐতিহাসিক বিতর্ক আজও আছে । ইস্টার উৎসব যে আসলে শস্য দেবীর পুজো সেকথাই তো বলছেন ইউরোপের গবেষকরা । আরও গবেষণা চলছে। শুধু এখন অপেক্ষায় থাকা।
Be First to Comment