জন্মদিনে স্মরণঃ নূরজাহান
বাবলু ভট্টাচার্য : তাঁকে দিয়েই শুরু হয়েছিল হিন্দি সিনেমার গানের নতুন অধ্যায়। স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর আগে লাহোরে তৈরি পঞ্জাবি ছবি ‘গুলেবকাওলি’-তে গুলাম হায়দারের সুরে তাঁর গাওয়া ‘শোলে জওয়ানিয়া মানে’ হিট গানের শুরু। তখন লাহোরের পাঞ্চোলি পিকচার্সের প্রায় সবকটি ছবির তিনিই ছিলেন নায়িকা-গায়িকা।
এই জয়যাত্রা সমান তালে চলেছিল বোম্বাইতে এসেও। খোলা গলায় গমগমে আওয়াজে গান গাইতেন নূরজাহান। তার কণ্ঠস্বর ছিল যেমন মধুর তেমনই পরিচ্ছন্ন। চড়া স্বরের সঙ্গে পাঞ্জাবি মুড়কির মিশ্রণে তাঁর গায়কীতে এমন এক আমেজ তৈরি হত যে সব সুরকারই তাঁকে দিয়ে গান গাওয়াতে চাইতেন। ঠুংরি, খেয়াল এমনকি ধ্রুপদ চালের গানেও সমান দক্ষতা ছিল নূরজাহানের।
নূরজাহান ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের কাসুরের একটি পাঞ্জাবী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমদাদ আলী এবং ফতেহ বিবি দম্পতির ঘরে এগারো ভাই বোনের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করেন।
লাহোরের এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে আল্লা ওয়াসেস পরবর্তীকালে ‘নূরজাহান’ নামে এই উপমহাদেশের বিখ্যাত নায়িকা-গায়িকা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সময়ের প্রায় সব নায়িকা-গায়িকাদের তিনিই ছিলেন আইডল।
লতা না নূরজাহান- অনেকটা সময়জুড়ে বোম্বাইতে এমন একটা দ্বান্দিক অবস্থান বজায় ছিল।
লাহোর ও বোম্বাইজুড়ে তাঁর হিট গানের ও ছবির সংখ্যা প্রচুর। এমনকি ১৯৬৩ সালে সেলিম ইকবালের সুরে ‘বাজি’ ছবিতে যে গানটি শেষ প্লেব্যাক করেছিলেন- ‘দিল কে আফসানে নিগাহো কি জুবান’ সেটিও ছিল সুপারহিট।
মাত্র পাঁচ বছর বোম্বাইতে ছিলেন। দেশভাগের সময় যখন তিনি মুম্বাই ছেড়ে পাকিস্তান ফিরে যান তখন তাঁর বয়স ছিল একুশ বছর।
বোম্বাই ছাড়ার তিন দশক পরে; গান-অভিনয় থেকে সরে যাওয়ার পরেও তাঁর প্রভাব কতদূর প্রসারিত ছিল তা তিনি নিজেই বুঝেছিলেন ১৯৮২ সালে। বোম্বাইয়ের মাটিতে পা দেওয়ার পর যেভাবে তাঁর কাছে শুভেচ্ছা, ভালবাসা, উপহার, আমন্ত্রণের জোয়ার এসেছিল তাতে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।
নুরজাহানের সঙ্গে আইয়ুব খানের একটি সম্পর্ক ছিল। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গেও নূরজাহানের সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুখরোচক কাহিনি রয়েছে। ইয়াহিয়ার মহিলাপ্রীতির কথাও সুবিদিত। পাকিস্তানের এই প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে ‘লেডিসম্যান’ বলা হত। অনেক মহিলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘মালিকা-এ-তরন্নুম’ নামে খ্যাত নায়ীকা-গায়িকা নূরজাহান।
নুরজাহানের একটি গানের বিনিময়ে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান বিক্রি করে দিতেও রাজি ছিলেন বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। একটা সময়ে নুরজহানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খান উতলা হয়ে পড়েছিলেন।
একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত হামিদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট চেয়ারে বসেই সারাদিন মদে বুঁদ হয়ে থাকতেন। অন্যদিকে তাঁর সঙ্গে পাঁচশো মহিলার সম্পর্ক ছিল বলে একটি দীর্ঘ তালিকাও ওই কমিশন তৈরি করেছিল, যাদের মধ্যে নায়িকা-গায়িকা নুরজাহান অন্যতম।
নূরজাহানকে ‘নূরি’ বলে ডাকতেন ইয়াহিয়া; আর তিনি ইয়াহিয়াকে ‘সরকার’ বলে সম্বোধন করতেন।
১৯৪২ সালে নূরজাহান লাহোর থেকে বোম্বাই এসেছিলেন ভিএম ব্যাসের আমন্ত্রণে। তিনি তাঁর ‘দুহাই’ ছবিতে গান ও অভিনয়ের জন্য নূরজাহানকে অনুরোধ করেছিলেন। সেই তখন থেকে দেশ ভাগ পর্যন্ত নূরজাহান মুম্বাই সিনেমা দুনিয়াকে আলোকিত করেছিলেন তাঁর গান আর অভিনয়ে।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান নূর জাহানকে অভিনয় এবং সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরুপ পাকিস্তানের অন্যতম সম্মানীয় পুরস্কার “প্রাইড অব পারফরমেন্স” প্রদান করেন। এছাড়াও তিনি পাকিস্তানি সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার তামা-ই-ইমতিয়াজ এবং সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পুরস্কার জিতে নেন।
২৩ ডিসেম্বর ২০০০ সালে ৭৫ বছর বয়সে পাকিস্তানের করাচিতে মৃত্যুবরণ করেন।
নূরজাহান ১৯২৫ সালের আজকের দিনে (২১ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment