জন্মদিনে স্মরণঃ গ ণে শ পা ই ন
বাবলু ভট্টাচার্য : কবিরাজ রো থেকে বিধান সরণির মন্দার মল্লিকের স্টুডিও পর্যন্ত মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের জীবন ছিল তাঁর আশৈশব পড়শি। তাদের জীবনচর্যার প্রান্তিকতাই কি তাঁর ছবিতে এত অন্ধকার মেলে ধরে? তাদের প্রাত্যহিকে নিহিত স্বাভাবিক কিন্তু অস্পষ্ট সংগ্রামই কি তাঁর ছবিতে একাধিক অনির্দিষ্ট আলোর উৎসব হয়ে ওঠে?
বিখ্যাত ‘বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট’ আন্দোলনের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী ছিলেন তিনি। শৈশব থেকেই যে সমস্ত উত্তাল রক্তাক্ত সময়ের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন তিনি, তাঁর রঙ- তুলি-ক্যানভাস পরবর্তীকালে সেই অশান্ত অন্ধকারময় সময়কেই জীবন্ত করে তুলেছে বারংবার।
বাংলা লোককাহিনি, কখনও বা পৌরাণিক কাহিনিকে তিনি তাঁর ছবির বিষয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন বারবার। মৃত্যু, বেদনা, একাকীত্ব তাঁর ক্যানভাসের কালো রঙের ভিতরে স্পষ্ট হয়ে ফুটে থাকে।
কলকাতা শহরেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর বড় ভাই কার্তিকচন্দ্র পাইনও ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। ছোটবেলায় ঠাকুমা নন্দরাণীর মুখে রূপকথা, লোককাহিনি ইত্যাদি শুনেছিলেন গণেশ। সেই কাহিনি শোনার অভিজ্ঞতা আজীবন তাঁর ভিতরে রয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর চিত্রকর্মেও প্রভাব ফেলেছিল বিস্তর।
চার বছর বয়সে গণেশ পাইনকে সিটি কলেজিয়েট স্কুলের শিশু বিভাগে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে যখন তাঁর নয় বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হয় যা তার উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কলকাতায় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে তাঁর পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। অবশেষে কলকাতা মেডিকেল কলেজের একটি নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয় তাঁদের। সেসময় গাড়ি বোঝাই মৃতদেহ আনার বীভৎস দৃশ্য দেখেছিলেন তিনি। রাস্তায় লাশের গায়ে হোঁচট পর্যন্ত খেয়েছিলেন তিনি। সেই স্মৃতি রঙে-রেখায় তাঁর ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল পরবর্তীকালে।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করবার পর গণেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার দিকে আর যাবেন না। বরং বড় কিছু করতে চান তখন। যদিও তাঁর প্রথাগত শিক্ষা থেকে সরে আসার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরিবারের লোকজন একমত হতে পারেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের ছেলে বিদ্যায়তনিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কোনো একটি কাজের জন্য যোগ্যতা অর্জন করুক।
অবশেষে তাঁর কাকা মনোহর পাইনের উদ্যোগে তিনি ভর্তি হন ‘গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট’-এ৷ চিত্রশিল্পে তাঁর দক্ষতা এবং সহজাত সৃষ্টি প্রবণতা দেখে তাঁকে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। গণেশ যদিও ওয়েস্টার্ন চিত্রকলা বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর হৃদয় পড়ে ছিল প্রাচ্য চিত্রকলার দিকেই।
১৯৫৯ সালে তিনি গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ভারতের প্রথম অ্যানিমেশন স্টুডিও মন্দার স্টুডিওতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। জীবনের এই পর্বটিও তাঁর ওপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মান্দার স্টুডিওতে একজন ড্রাফটসম্যান হয়ে ওঠেন তিনি।
স্টুডিওটি পরিচালনা করতেন বিদ্রোহী চলচ্চিত্র পরিচালক মান্দার মল্লিক যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি সফর করেছিলেন এবং ফ্রিটজ ল্যাং এবং লেনি রিফেনস্টালের সংস্পর্শে এসেছিলেন। মল্লিক ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর মতো কলকাতায় একটি প্রাণবন্ত কার্টুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি তার শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে অভিজ্ঞ ডিজনি অ্যানিমেটর ক্লেয়ার উইকসকে নিয়ে এসেছিলেন। উইকসের কাছে পাইন শিখেছিলেন বিভিন্ন আবেগ প্রকাশের জন্য চরিত্রের আকৃতিকে কীভাবে বিকৃত এবং অতিরঞ্জিত করতে হয়।
১৯৬৩ সালে গণেশ ‘সোসাইটি ফর কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট’ -এ যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে বিকাশ ভট্টাচার্য, শ্যামল দত্ত রায়, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত এবং গণেশ হালুইয়ের মতো স্থানীয় শিল্পীরা ছিলেন। শীঘ্রই চিত্রশিল্পের এই নব্য আন্দোলনের একজন মুখ্য অংশ হয়ে ওঠেন গণেশ পাইন। যদিও রঙ দিয়ে ছবি আঁকতে পারতেন না সেসময়, কিন্তু এসময় চিত্রকর্মে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন তিনি।
ছাত্রাবস্থায় ডাচ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্টের দ্বারাও ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। পরাবাস্তববাদী এবং বিমূর্ত ছবিগুলি জলরঙে আঁকা শুরু করেছিলেন তিনি, তারপর গাউচে, টেম্পারা, আভারী ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাজ করতে থাকেন। মহাভারতের উপর আঁকা তাঁর সিরিজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চিত্রকর্ম হল, ‘বয় অ্যান্ড দ্য পেইন্টেড হর্স’, ‘বিফোর দ্য চ্যারিয়ট’ (১৯৭৮), ‘দ্য সেন্টস অ্যান্ড দ্য অফিসিয়ালস’ (১৯৯১), ‘নাইট অফ দ্য পাপেটিয়ার’ (১৯৯৪) ইত্যাদি।
১৯৬৯ সালে প্যারিস বিয়েনেলের প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি অংশগ্রহণ করেছিল। আবার ১৯৭০ সালে পশ্চিম জার্মানিতে সমসাময়িক ভারতীয় চিত্রকর্মের প্রদর্শনীতেও তাঁর ছবি জায়গা পেয়েছিল। এছাড়াও প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটনে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল।
দিল্লির ‘দ্য ভিলেজ’ গ্যালারিতে প্রথম গণেশ পাইনের একক প্রদর্শনী হয়েছিল। তখন তাঁর বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর। ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে কলকাতার ‘সেন্টার অফ ইন্টারন্যাশনাল মডার্ন আর্ট’ তাঁর কাজের বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল।
২০১১ সালে ‘ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স’ চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার প্রদান করেছিল গণেশ পাইনকে। কেরালা সরকার রাজা রবি বর্মা পুরস্কারে সম্মানিত করেছিল তাঁকে।
গণেশ পাইনকে নিয়ে লেখা হয়েচে একাধিক গ্রন্থ। এলা দত্ত রচনা করেছিলেন ‘গণেশ পাইন, হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস’-এর মতো বই। রঞ্জিত হোসকোটের লেখা ‘গণেশ পাইন : আ পিলগ্রিম ইন দ্য ডোমিনিয়ন অফ শ্যাডোজ’ একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
১৯৯৮ সালে বিখ্যাত পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত গণেশ পাইনকে নিয়ে ‘আ পেইন্টার অফ ইলোকেন্ট সাইলেন্স: গণেশ পাইন’ নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন। সেটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা বিষয়ক চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়৷
২০১৩ সালের ১২ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৬ বছর বয়সে গণেশ পাইনের মৃত্যু হয়।
গণেশ পাইন ১৯৩৭ সালের আজকের দিনে (১১ জুন) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment